আমি প্রায়ই ভাবি আমি সেই গল্পটা আপনাদের সবাইরে বলব। এই গল্প আপনাদের প্রায় সকলের জানা গল্প, তারপরেও আমারে সেই গল্প বলতে হবে। নানান কায়দায় আমি এই গল্প বইলা যাব বইলা আমার মনে হয়। আমার অনেক বয়স হইয়া গেলেও আমি এই গল্প করতে পারলে খুশি হব। আমার কাছে যদি কেউ আসে অনেক তরুন কেউ, আর যদি নাও আসে, তারপরেও আমি এই গল্প করব। চা এর দোকানে বইসা, বা অন্য যেখানে সুযোগ পাওয়া মাত্র এই গল্প আমি জুইড়া দিব। গল্পটা বেশি বড় না। এই গল্প হইল সেই গল্প যেখানে একটা ক্রিকেট শট কিভাবে একটা জাতির মানসিকতারে চিরতড়ে বদলাইয়া দিছিল। আমার গল্প আপনাদের অতিশয়োক্তি মনে হইতে পারে। মনে হইতে পারে বাড়াবাড়ি, কিন্তু বিশ্বাস করেন এই গল্পটা এক বিন্দু বাড়াইয়া বলানা। মীথ না সত্য গল্প।
বাংলাদেশ নামে একটা দেশ ছিল। সেই দেশের লোকজন নানা রকম খেলায় অংশ নিত। কিন্তু বেশিরভাগ, মানে প্রায় সকল খেলাতেই ওরা খালি হারত। ওরা ক্রিকেটও খেলত। কিন্তু এই খেলাতেও বেশির ভাগ সময় হারত। মাঝে মইধ্যে দুই একটা ম্যাচ জিতলে সেই দেশের লোকজন প্রায় পাগলে মত এদিক সেদিক ছোটাছুটী করত আনন্দে। যখনই বাংলাদেশ কোন ক্রিকেট ম্যাচ জিতা যাইত, কালে-ভদ্রে, তখনই লোকজন রাস্তায় বাইর হইয়া আসত। আর চিত্কার করত সমস্বরে। কিন্তু এমনদিন অদের ভাগ্যে খুব কমই আসত, কেননা, আগেই যেমন বললাম, সেই দেশ ক্রিকেট খেলায় জিতত খুব কমদিনই।
সেইরকমই একটা দিন আসছিল ২০০৭-এ। আপনাদের মনে আছে সেই বিশ্বকাপে ভারত ছিল একটা ফেভারিট দেশ। বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপ তাদের। শচীন টেন্ডুল্কার, রাহুল ড্রাভির, বীরেন্দর শেবাগ, সৌরভ গাঙ্গুলী, যুবরাজ সিং আর মহেন্দ্র সিং ধোনীর এর মত বিশ্ব সেরা ব্যাটসম্যানরা আছে সেই দলে। আর বাংলাদেশ তখন নিন্তাতই শিশু দল। খেলায় জিতার রেকর্ডের বিচারে যেমন তেমনি খেলোয়াড়দের বয়স বিবেচনাতেও ছিল শিশুপ্রায় দল। দলের গড় বয়স ছিল ১৮। খেলোয়াড়রা এতই কম বয়স্ক যে, হাবিবুল বাশার বা মোহাম্মদ রফিকের মত সিনিয়র খেলোয়াড়রা তাদের বয়সের গড়ের কমজোরি কমাইতে পারে নাই। বেশির ভাগই ছিল অনুর্ধ-১৯ এর বাচ্চা পোলাপাইন। দেশের মধ্যেই অনেকে এদের চেনেনা আর বিদেশীরা তো দূরের কথা। তামিম, নাফিস, মুশফিক, সাকিব, আফতাব, মাশরাফি, আশরাফুল, হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ রফিক, আব্দুর রাজ্জাক, সৈয়দ রাসেল। এই ছিল বাংলাদেশ এর দলের খেলোয়াড়রা।
অন্যদিকে ভারত দল ছিল বিশ্বকাপের কন্টেন্ডার দল। ১৯৮৩ সালের পর ভারত বিশ্বকাপ পাইতেসে না অনেক দিন। এরই মইধ্যে ভারতের বিসিসিআই বিশ্বের সবচাইতে পয়সাওয়ালা ক্রীড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিনত হইসে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য বিপুল টাকা বেতন দিয়া অস্ট্রেলিয়ার লেজেন্ড গ্রেগ চ্যাপেলরে কোচ করা হইসে। নতুন ক্যাপ্টেন বানানো হইসে ঠান্ডা মাথার রাহুল দ্রাভিররে। আর বিশ্বাস করেন, ভারতীয় সাধারন জনতা থাইকা শুরু কইরা মন্ত্রী মিনিষ্টার আর সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত খোলাখুলি চাইতেছিল যেভাবেই হউক ভারতের এইবার কাপ নিয়া আসতে হবে।
আর বাংলাদেশের কথা তো আগেই বলছি।খালি হারে এমন একটা দল। এদের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়াই টানাটানি চলতেছিল। বাংলাদেশের মানুষ তাদের দেশ বিশ্বকাপে খেলে এতেই খুশী, কারু সাথে কোন ম্যাচ জিতলে সেইটা উপড়ি পাওনা। প্রথম খেলা শক্তিশালী ভারতের সাথে, সেইটাতে একটা সম্মানজনক ফলাফল হইলেই সে দেশের জনতা খুশী হইয়া যাবে। ওরা তখনও সেই খবর পায় নাই যে ওদের দলের বাচ্চা বাচ্চা খেলোয়াড়েরা অন্য রকম কিছু ভাবতে শুরু কইরা দিসে। মাশরাফী নামে পেস বোলার পোলাটাতো এক সাংবাদিকের সামনে ফস কইরা বইলাই বসছে, ‘ভারত হইসে ত কি হইসে, ধইরা দিবানি’। গোলিয়াথ বধের বাসনা থাকে মনে মনে অনেক পিচ্চি ডেভিডের, সেইটা বাসনাই থাইকা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আর দলটা যেইখানে ভারত। সেইখানে মাশরাফির ‘ধইরা দিবানি’রে কেউ খুব একটা আমলে নিছিল বইলা মনে হয় না।
১৭ মার্চ, ২০০৭ সেই ম্যাচে টস জিতল ভারত। ব্যাটীং নিল। দেখা গেল বাংলাদেশের সেই তরুন পেসার মোটেই ঠাট্টা মশকরা করে নাই প্রথম স্পেলেই মারাত্মক বিপদজনক ব্যাটসম্যান, ‘নজফগরের কসাই’ বইলা খ্যাত বিরেন্দর শেবাগরে বোল্ড কইরা দিল। উজ্জিবীত বাংলাদেশের বোলাররাও চাইপা ধরলো ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। গাংগুলীর ৬৬ রান ছাড়া আর বলার মত কেউ রান করতে পারে নাই। ইনিংসের তিন বল বাকী থাকতেই ভারত ১৯১ রানে অলআউট। ভারতরে ২০০ এর নীচে আউট কইরা দেয়াতে বাংলার ঘরে ঘরে ফিসফিসানী শুরু হইয়া গেল। যদিও অতীত ইতিহাস আমাদের আশবাদী হইতে দিতেছিল না। তাতে কি? বাংলাদেশের মানুষের চোখ আটকাইয়া গেসিল টেলিভিশন এর পর্দায়। সেদিন ছিল শনিবার। বাংলাদেশের অনেকেরই ছুটির দিন ছিল সেইদিন।
বাংলাদেশের ব্যাটিং শুরু করলো শাহরিয়ার নাফিস আর তামিম ইকবাল। তামিম ইকবালটা কে? তামিম তখনো আমাদের কাছে টেস্ট ব্যাটসম্যান নাফিস ইকবালের ছোট ভাই, আর প্রাক্তন অধিনায়ক আকরাম খানের ভাতিজা। মাত্র ডেব্যু করছে জিবাম্বুয়ের সাথে। তামিম অল্প বিস্তর খ্যাতি এই বইলা যে সে খুব জোরে বলরে পিটাইতে পারে। কিন্তু সে যেইভাবে ভারতের বোলারদের খেলতেছিল সেইটা দেইখা কে বলবে যে ওর বয়স তখন মাত্র ১৭ চলতেসে। আমরা মনে মনে ভাবতেছিলাম অভিজ্ঞ ইন্ডিয়ান বোলাররা না জানি কেমনে চাইপা ধরে আমাদের ব্যাটসম্যানদের। কিন্তু তামিম, জহির খান আর অজিত আগারকাররে খেলতেসিল এমন ভাবে যেন খুব সাধারন বোলার এরা। শাহরীয়ার আউট হইয়া গেল অল্পরানে। মুশফিক নামের উইকেট কীপার ব্যাটসম্যান জয়েন করল তামিমরে। তামিমই বাউন্ডারি বাইর করতেছিল অসাধারন সব শট খেইলা। ১০ ওভার পরে বাংলাদেশ এর রান ছিল ৪৫ এক উইকেটে।
তারপর আসলো সেইক্ষন। তামিমের ব্যাটিং ইতিমধ্যে রাহুল দ্রাভিড়রে চিন্তায় ফালাইয়া দিসে। ১০ নম্বর ওভার এর শেষ বলে তামিম ক্রীজ থাইকা বাইর হইয়া পয়েন্টের ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়া মুনাফ প্যাটেল এর বল উড়াইয়া ফালাইছে বাউন্ডারীর বাইরে। দ্রাভির স্বিদ্ধান্ত নিল ওদের মেইন স্ট্রাইক বোলার জহির খানরে কন্টিনিউ করার। স্ট্রাইকে ছিল মুশফিক। প্রথম বলেই একটা সিংগেল নিয়া স্ট্রাইক দিল তামিমরে। তামিমের নিজের রান তখন ৩৭। জহির দ্বিতীয় বলটা করল অফ স্ট্যাম্পের বাইরে গুড লেংথ বল। তামিম মন করেন গজফিতা নিয়া মাইপা কভার আর মিড অফের ঠিক মাঝখান দিয়া বল পাঠাইয়া দিল বাউন্ডারীর বাইরে। বলটা প্রথম বাউন্সটা নিল ৪০ গজের কাছকাছি গিয়া। জহির খানের ক্যাচ ইট চিত্কার শেষ হওয়ার আগেই বল গিয়া বাড়ি খাইসে এডভার্টাইজিং বোর্ডে। কাভার আর মিড অফের ফিল্ডার এক অন্যের দিকে তাকাইয়া থাকল কতক্ষন। মনে হইল যে একে আরেকজন কইতেছিল-যা তুই নিয়া আয় বলটা। যাই হউক, পরের বলটায় রাউণ্ড দ্যা উইকেট আসলো জহির খান। তামিম স্ল্যাশ কইরা চোখের পলকে পয়েন্টের উপড় দিয়া বাউন্ডারী ছাড়া করলো। চাইর। জহির খানের অবস্থাটা একবার ভাবেন। ক্যাপ্টেন তারে ৬ নম্বর ওভারটা দিছিল এই ভাইবা যে একটা উইকেট নিয়া নিবে। আর সেই কিনা পর পর দুই বলে দুইটা বাউন্ডারী খাইয়া বইসা আছে। চতুর্থ বলে রান আসে নাই। ওভারের ৫ নম্বর বলটা করতে আসলো জহির খান। তামিম এক লাফে সামান্য লেগের দিকে সইরা সামনের দিকে আগাইয়া আসলো, জহির বলটা করলো তামিমের অফ স্ট্যাম্পের উপড় গুড এর চাইতে খাটো লেন্থে। তামিম একলাফে আগাইয়া আইসা বলটারে মিডউইকেটের উপড় দিয়া উড়াইয়া ফালাইলো গ্যালারির দোতলার টিয়ারে। বলের গতি এমন ছিল যে, মাঠটা যদি আরো ১০ মিটার বড় হইত তাতেও এইটা ছক্কা হইত। এমসিজি বা লর্ডসের মাঠেও এইটা আনয়াসে বাউন্ডারী পার করত। জহির খান মাথা নিচু কইরা ওর বোলিং মার্কে ফিরা গেল। আর সারা দুনিয়া দেখল বাংলাদেশের ১৭ বছর বয়সী এক বালকের দুঃসাহিসী ব্যাটিং। আমি ক্রিকেট খেলা দেখি সেই কবে থাইকা, কিন্তু বিশ্বাস করেন এমন ডিসমিসিভ শট আমি আজ পর্যন্ত দেখি নাই। কি ফলো থ্রূ! কি শরীরের ভাষা! কি অদ্ভূত নিখুঁত টাইমিং! আর কি পাওয়ার শটে। এর পরেও এই ম্যাচের গল্প বাকি। সেই গল্প আজকে আর বলব না। বলাটা ঠিক হবে না।
বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতছিল। সহজেই। মুশফিক আর সাকিব নামের আরো দুই বালক খুব ভাল ফিফটি করছিল। কিন্তু তামিমের এক ছক্কার পরে আর কখনো মনে হয় নাই, বাংলাদেশ কোন আন্ডার ডগ দল। সেই থিকা শুরু এর পর থাইকা আর কোণদিনই এই পোলাপাইনগুলা বাংলাদেশরে আন্ডারডগ ভাবতে দেয় নাই। বাংলাদেশ এর পরে সব ম্যাচ জিততে শুরু করছে এমন কিন্তু মোটেও না। এর পরেও এরা অনেক ম্যাচ খুব বাজে ভাবে হারছে। কিন্তু সেই শরীরের ভাষা যেইটাতে মনে হইত ওরা বড় কোন দলে সাথে খেলতে পাইরাই খুশী সেইটারে তামিম ইকবাল এক ছক্কার মাইরে সোজা আটলান্টিকে ফালাইয়া দিয়া আসছিল। তামিমের ছক্কাটাই বাংলাদেশ দলের ভাবমুর্তি বদলাইয়া দিছে। তামিমের শটটা এমন ছিল যেন মনে হইতেছিল খালি বলটরে সে স্টেডিয়ামের বাইরে ফালাইতে চায় নাই বলটার সাথে সাথে ‘খেলা শুরুর আগেই হাইরা যাওয়ার’ মানসিকতাটারে বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমের বাইরে পাঠাইয়া দিছে চিরতরে। গজ-ফিতা দিয়া মাইপা বলা যাবেনা কত বড় ছিল সেই ছক্কা। আমি অনেক বড় বড় ছক্কার দেখসি। ইমরান খানরে দেখসি পার্কিং লটে গাড়ির কাঁচ ফাটাইতে, জয়সুরিয়ারে দেখসি রাস্তার ঐ পাড়ের পার্কে বল পাঠাইতে, কমেন্ট্রি বক্সের কাঁচ ফাটাইতে দেখালাম জানি কারে, গেইল তো কতই বড় বট ছক্কা মারে কিন্তু তামিম ইকাবালের সেই ছক্কার মতো এত বড় ছক্কা আমি কোনদিন দেখি নাই।
শুরুতে যেমন বলছিলাম, একদিন আমি তরুন থাকব না, তরুনরা আমার সংগ উপভোগ করবে না, কিন্তু আমি তখনো সূযোগ পাইলেই তাদের জিজ্ঞেস করবো, একটা গল্প শুনবা? একটা ছক্কার গল্প? যেই ছক্কা একটা পুরা জাতির মানসিকতারে পাল্টাইয়া দিছিল?
– Iftequer Lipu