ঝরি সমাচার ************** কুড়িগ্রামে বৃষ্টিকে বলা হয় ঝরি।

ঝরি সমাচার
**************
কুড়িগ্রামে বৃষ্টিকে বলা হয় ঝরি। যেমন বৃষ্টি পড়ছে কে বলা হবে ঝরি পড়ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না বৃষ্টির থেকে ঝরি শব্দটাই আমার বেশি প্রিয়। কিন্তু প্রিয় হয়ে লাভ নেই, লিখতে গিয়ে ঝরির সাথে না থেকে বৃষ্টির সঙ্গে থাকতে হয়। এটাই লেখ্য রূপ। আর লিখবই বা কী! বাংলা বানানে আমার ভয়ঙ্কর রকমের ডিসলেক্সিয়া আছে। একই শব্দ এক একবার এক এক বানানে লেখার আমার অভ্যাস। যখন লিখতে যাই, শব্দের মাধুর্যে বানানগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। তাই বলে কী আর লেখা বাধা থাকবে রে ভাই। লিখতে তো হবেই। লেখালিখি নিশ্বাস নেয়ার মতো একটা ব্যপার। বেঁচে থাকব আর লিখব না! এই ভাবে বেঁচে থাকা যায়!

কুড়িগ্রামে বড় হয়েছি। আসলে বলতে হবে রাঙ্গালির বসে বড় হয়েছি। এটা আমার গ্রাম। একদম গণ্ডগ্রাম। মনে আছে ছোট বেলায় দাদির সাথে মহিষের গাড়িতে চেপে তার বাপের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। সেই গাড়িতে নরম তোষক বিছানো থাকতো, সুন্দর চাদর আর বালিশ। ছইয়ের (ছাউনি) ভেতরে থেকে মুড়ির মোয়া, পিঠা খেতে খেতে সারাদিন পর পৌছে যাওয়া যেত। আর যে রাস্তা ছিল, সেখানে গাড়ি খুব সুবিধে করতে পারত না বর্ষাকালে। গ্রাম কতখানি গ্রাম হতে পারে সেই উদাহরণের জন্য এ বিষয়টা বলে রাখলাম। আমার সেই ছবির মতো গ্রামে ছোটবেলায় বৃষ্টি হলে খুব বেশি আনন্দ প্রকাশ করা যেত না বাবার কারণে। আমার বাবা খুবই রাগ করতেন। কেন?

আমার বয়স যখন চার, তখন থেকে বাবার ইট ভাটার ব্যবসা। শীতের আগমনের সময় থেকে ইট বানানো শুরু হতো। সেই সময়ে কেবল বরই গাছে ফুল আসতো। ভাটার মাঠে কাচা ইটের উপরে রাতের ঝরে পড়া বরই ফুল অদ্ভুত ভাবে নক্সা করে রাখত। ইটের ক্ষতি হওয়ার পরেও বাবা কেন জানি এই গাছটা কখনো কেটে ফেলতে বলে নি। এমন করে বর্ষার শুরু পর্যন্ত ইট বানানো চলত। কিন্তু বৈশাখ মাসের প্রথম বর্ষায় আমরা উচ্ছাস করতে পারতাম না। বৃষ্টি মানেই নতুন করে আবার ইট বানানোর শুরু। বাবার বিশাল লোকশান। তবে দেখেছি প্রবল বর্ষণ হচ্ছে, বাড়ির টিনের চালে মনে হচ্ছে যেন হাজারটা শব্দতরঙ্গের সমাহার, সেই সময়ে বাবারও মন ভালো হয়ে যেত। গভীর রাতে আয়োজন করে চালভাজা করতে বলতেন। অনেকটা নিরোর বাঁশি বাজানোর মতো, বাবার ট্রয় তখন পানিতে সয়লাব।

এরপর যখন ভাটার কাজ বন্ধ হয়ে যেত, বাবার তখন আসল আনন্দ। অনেক আয়োজ করে বাড়ির সামনে পুকুর এবং জলাশয়ের পানিতে মাছ ধরতেন। বৃষ্টিতে ভীজে ভীজে আমরা ভাইবোনেরা বড়দের সঙ্গেই থাকতাম। হাতের আঙ্গুলের সব চামড়া কুচকিয়ে থাকতো অদ্ভুত ভাবে। কাদায় থেকে থেকে পায়ের আঙুলের মাঝে ঘা হয়ে যেত। তারপরেও কে রোখে মোরে অমৃত সুধায়!

আমার বৃষ্টি নিয়ে পাগলামি নিয়ে বন্ধু-বান্ধবেরা হাসাহাসি করেন। খারাপ লাগে না এই হাসির পাত্র হতে। অনেকেই বলেন হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সবাইকে বৃষ্টি ভালো বাসতে শিখিয়েছেন, হুমায়ূন ভক্ত হিসেবে এটা আমিও স্বীকার করি কোন যুক্তি ছাড়াই। কিন্তু আদতে আমার মনে হয় বৃষ্টিকে ভালোবাসার কারণটা সকল কৃষি প্রধান সভ্যতার মানুষের জেনেটিক ভালোবাসা। বৃষ্টি মানেই কৃষকদের জন্য আশির্বাদ। বৃষ্টি মানেই ফসলের উত্থান। তাই এই চাষাদের দেশের আমরা সবাই মনে হয় বাদল ধারার কদর করি। আনন্দে সবাই এক একজন রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাই।

ছোট বেলায় বৃষ্টি এলে আমি বাড়ির সামনের পুকরে নেমে যেতাম। কান পানির নীচে ডুবিয়ে পানির লেভেলে চোখ রাখতাম। পানিতে বৃষ্টির ফোটায় যে জলতরঙ্গ হতো সেটা অদ্ভুত লাগত। আর চোখ দিয়ে বৃষ্টির ফোটার নৃত্য দেখতাম। যারা বৃষ্টির এই রূপ দেখেন নি, একবার করে দেখেন। এই অভিজ্ঞতা হলে আমার মতোন বাকী জীবন নস্টালজিক হয়ে থাকবেন, এটা আমার গ্যারান্টি। বিফলে মূল্য ফেরত।

**//** ধানমন্ডি, ঢাকা।

Related posts

Got all my collected paintings and photographs in Mounts

Harry Potter again

Happy Birthday Towhed

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Read More