ঢাকা-চেনা-অচেনা-মানুষ!

প্রথম ঢাকা আসি কবে? মনে হয় ১৯৮৯ সালে। আমার কাজিনের বিয়ে হয়েছিল গাজীপুর, সেই উপলক্ষে ঢাকা ভ্রমণ। কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা অনেক দূর। আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ৪৬০ কিলোমিটার। পার হতে হতো যমুনা, ফেরিতে। মোট ১২ ঘন্টার পথ।

সেই সময়ের ঢাকা মানে চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, জাদুঘর, এয়ারপোর্ট। মোটামুটি ভয়ংকর একটা বাসে করে ঢাকার যাত্রা শুরু হতো। পুরো রাস্তায় বমি, গরম! বিভীষিকাময় একটা ব্যাপার। তবুও ঢাকা। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। ঢাকা বুড়িগঙ্গা’র তীরে অবস্থিত।

প্রথম ঢাকা মানে গাজীপুর এসে পুরা একদিন ঘুম। ছোট শরীর, ঘুম তো আসবেই। পরের দিন শুরু হল সত্যিকারের ঢাকা দর্শন। গাজীপুর থেকে বাসে করে সোজা গুলিস্থান। সাথে আছেন আমার কাজিন। ওরা ঢাকায় অনেক দিন থেকে। ঢাকা ঢোকার পথে যেটা চোখে পড়েছিল তা হল মানুষ। পুরা শহর গিজগিজ করছে মানুষে (এখনকার মানুষের অর্ধের ছিল মনে হয় তখন, তাতেই সেই ধারনা)।

ওভার ব্রিজ এ চড়ে গাড়ি দেখেছিলাম। এত গাড়ি জীবনে এক সাথে দেখি নাই! জীবনের প্রথম সত্যিকারের ভাল আইসক্রীম খেলাম। অনেক তীব্র একটা অনুভুতি। আইসক্রীম আমার অনেক প্রিয় ছিল, এখনো আছে। তারপর একে একে চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, শিশুপার্ক দেখা শেষ করলাম। বেবী ট্যাক্সির ধোয়ায় চোখের অসহ্য জ্বালাপোড়া, এক দিনেই। সন্ধায় আবার গাজীপুর। অনেকটা স্বপ্নের মতন একটা অভিজ্ঞতা।

এর পরের বার ঢাকা আসি বাবা মার সাথে। বেড়াতে। ১৯৯০ সালে। গুলিস্থান এর হোটেল আল মনসুর এ হয় আমাদের ঠিকানা। গুলিস্থান মানেই লোকারণ্য। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। সেবার অনেক দিন ঢাকায় ছিলাম। অনেক ভাল একটা সময় কেটেছে।

এর পর ১৯৯৪ সালে হোলি চাইল্ড স্কুল এ পড়তে আসি। স্কুলটা ছিল উত্তরায়। আমার প্রায় আড়াই বছর সময় কাটে এখানে। ১৯৯৬ তে আবার কুড়িগ্রাম চলে যাই।

হোলি চাইল্ড এ ছিলাম হোস্টেল এ। বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন ভাষার ছাত্র সব। অনেক ধরনের মানসিকতার সাথে পরিচয় হল। অনেক বড় একটা অভিজ্ঞতা। আমার স্কুলের সেই বন্ধুদের সাথে এখনো আমার প্রানের সম্পর্ক। কম বয়সের বন্ধুরা সব। তখনও ঠিক স্বার্থপরতা শেখা হয়ে ওঠেনি। যেহেতু হোস্টেলে ছিলাম, বাইরের ঢাকাটা দেখা হয়ে ওঠেনি। ২০০০ সালে আবার ঢাকায় আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উদ্দেশে।

আমার প্রথম ঠিকানা শুরু হয় কালাবাগান এ (আমার বর্তমান বাসার একদম পাশে)। আমার বয়স তখন ২০। একা একা চলে শুরু করেছি মাত্র। নিজের ভঙ্গিতে ঢাকা দেখা শুরু করলাম। শহরটার মজা বোঝা শুরু করেছিলাম। এই শহরের বিচিত্র মানুষ গুলন কে অনেক পছন্দ করে ফেললাম। এই মজার শহরে থাকার চিন্তা করে ফেললাম সেদিন থেকেই। এখনো রয়ে গেছি। কুড়িগ্রাম থেকে এসে ঢাকায়।

আস্তে আস্তে সময় যায়,আমিও ধীরে ধীরে বেড়ে উঠি। শহর টা আমাকে নিজের করে নেয়, আমিও। সহরটার যান্ত্রিকতা আস্তে আস্তে আমাকে যান্ত্রিক বানিয়ে ফেলল। জীবন যুদ্ধের শহর হয়ে গেল আমার।

সব মিলিয়ে প্রায় ১৪ বসর ঢাকায়। অনেক মানুষ দেখলাম। অনেক কিছুই শিখলাম। শহর আমাকে অনেক কিছু দিল, আমিও দিলাম। খুবই স্বার্থের একটা শহর। simple give and take.

গত পরশু আমার মনটা ভাল হয়ে গেল বসুন্ধরা শপিং মল এর সামনে। গাড়িতে বসে আছি জ্যাম এর কারণে। দেখি একটা মেয়ে হাতে একটা গোলাপ ফুল এবং সাথে একটা পেপার নিয়ে এল হাসি মুখের। ফুলের জন্য গ্লাস নামিয়ে নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম কত? জবাবে কোনও দাম চাইল না। পড়ে বুঝলাম একটা হাসপাতালের  সার্ভিস প্রচার করার জন্য এই ব্যবস্থা! আমি কিন্তু অনেক খুশি। অনেক কাল পড়ে আমাকে কেউ একজন একটা ফুল দিল। আর তখনই এই ইট সিমেন্ট এর শহরটার যন্ত্র মানুষ গুলোকে ক্ষমা করে দিলাম। যারা একটা গ্রামের ছেলের মনটাকে অনেক যত্ন করে নষ্ট করে দিয়েছে। গোলাপ টা হাতে নিয়েই কাঁটার খোঁচা! রক্তাত্ত হলাম একটু। তবুও গোলাপ ফুটেছিল একটা, আমার জন্যে!

Related posts

Few Photographers Together

Got all my collected paintings and photographs in Mounts

Harry Potter again

2 comments

ether February 2, 2011 - 7:29 pm
ভাল্লাগসে :)
Sawon April 19, 2011 - 5:16 am
নির্ঝর ভাইয়া, ভাল লাগলো, খুব। খুব ইচ্ছা আপ্নার সাথে একদিন দেখা করার।
Add Comment