খুব বেশিদিন আগের কথা না। গত ফেব্রুয়ারি মানে ২০১৭ এর দ্বিতীয় মাস। আমার প্রথম উপন্যাস (একমাত্র প্রকাশিত উপন্যাস) ছোট কাকের পাহাড় জয় বের হয়েছে। নিজের মধ্যে একটা লেখক লেখক ভাব। এমনিতেই সবসময় পাঞ্জাবি পরি (আমার মেদ-ভুরি। অন্যকোন পোশাক মানায় না) তাই আগত বইমেলা উপলক্ষে অনেকগুলো নতুন পাঞ্জাবি কিনে ফেললাম ৫০% মূল্যছাড়ে। যেহেতু বাজারে আমার বই তাই লেখক না দাবি করার জায়গা নেই। বেশ আয়োজন করে পাঞ্জাবি, চাদর গায়ে দিয়ে বইমেলায় হাটাহাটি করি। আমার ভাবটা এমন যে বিশাল ক্লাসিক লিখে ফেলেছি। এই বইমেলায় কাজের কাজ হয়েছে আমার ওজন খানিকটা কমে গেল হাটাহাটি করতে করতে। বইমেলায় বসার কোন ব্যবস্থা ছিল না।
বইমেলা শেষ হয়ে গেল। আমার আপনজনেরা বলল আর যেন ছোটদের জন্য না লিখি। একবার ছোটলেখক মানে ছোটদের জন্য যে লেখক লিখেন, সেই লেখকের তকমা গায়ে লেগে গেলে নাকি আর বড়দের বই লিখলেও কেউ পড়বে না। সেইসময় যে যাই বলে মনোযোগ দিয়ে শুনি এবং কোন চিন্তা না করেই সিদ্ধান্ত নেই আর ছোটদের বই নয়। এবার লিখতে হবে একদম প্রেমের উপন্যাস। কিন্তু বিধির বিচার বড় নিষ্ঠুর। উপন্যাস লিখতে বসে মাথায শুধু আসে রূপকথা। আমার কন্যা অরুন্ধতী রূপকথা না, ফেইরি টেইল। তাই আমার প্রেম হওয়ার আগেই মানে প্রেমের উপন্যাসের আগেই আর একটা রূপকথা লেখা শুরু করে দিলাম। নিজেকে শান্তনা দিলাম যে এইটা অবশ্যই প্রেমের উপন্যাসের পরে প্রকাশ করব। জমজমাট প্লট। লিখলাম কয়েক দিন। তারপরে আবারো প্রেমের উপন্যাস লেখার ঝোক। মাঝপথে থেমে গেলাম। আমার কন্যার মা দীর্ঘ ছয় বছর পর ইমেইলে আমার সাথে যোগাযোগ করলেন। প্রেমের উপন্যাস লেখায় কিছুটা বিরতি পরল।
প্রেম বা হৃদয়ঘটিত বিষয়ে আমি বরাবরের মতোই একটু এলোমেলো। আমার অবস্থা হলো চাঁদের আলোয় যারে দেখি তারেই লাগে ভালো টাইপের। আর প্রেম, বিবাহ সংসার এইগুলা ঠিক সিরিয়াস ইস্যু ছিল না। একটু খোলাসা করি।
আমার কন্যার মায়ের নাম নাজিয়া সুলতানা সরণি। ২০০৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর তার সাথে প্রথম দেখা। আর ২০১০ সালেল ১ জানুয়ারি আমরা বিয়ে করি। এখন পাঠক মাত্রই প্রশ্ন করতে পারেন ‘এই ১৫ দিনে প্রেম হয়?’ আমি বলব আলবত হয়। আমি সরনির প্রেমে ডুবে গেলাম। আসলে প্রেমে পড়লাম তার মেধার। এই মেয়ে সবে মাত্র বুয়েট থেকে পাশ করেছে। আগাগোড়া ফ্রেমে সাজিয়ে রাখার মতো রেজাল্ট। তার উপর ছবি তোলে। অনেক কবিতা পড়ে। অনেক বই পড়ে। আমি প্রেমে পড়ব না তো কী করব? ছাদের রেলিং ধরে ঝুলে থাকার পাবলিক আমি না।
বিয়ে করে ঠিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার কন্যা তার মায়ের গর্ভে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ফেলল। এবং জাগতিক নিয়মেই ৫ নভেম্বর, ২০১০ জন্ম নিল। Remember remember, the fifth november… ‘ আমার অনেক প্রিয় সিনেমা ভি ফর ভেনডেট্টা। অসম্ভব ভালো একটা দিনে (আসলে রাত হবে) রূপকথা জন্ম নিল।
আকস্মিক বিয়ে, সন্তান এবং সংসার নামক পার্মানেন্ট ট্যাটু মিলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি আর আমার মেয়ের মা আলাদ হয়ে গেলাম। আরো ৩ বছর পর ডিভোর্স।
আমার মতো এই রকম ছন্নছাড়া একটা মানুষ প্রেমের উপন্যাস লিখতে পারা কঠিন। কিন্তু সমস্যা হলো লেখার ছাড়পোকা বড় ভয়ঙ্কর জিনিস রে ভাই। এইটা একবার হলে রোদে শুকিয়েও ঠিক যায় না। থেকেই যায়। আর সুজোগ পেলেই মাথায় কুটকুট করে। তো আবার লিখতে বসলাম। প্রেমের উপন্যাস। যা হতে পারত কিংবা যদি এমন হতো ভাবতে ভাবতে কেমন করে জানি একটা উপন্যাস দাড়িয়ে যাচ্ছে।
মেয়ের মা একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সেই সুবাদে তার বিদেশে ট্রেইনিং এ যেতে হবে। দীর্ঘ সারে ছয় বছর পর আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন। এবং বললেন রূপকথার কাস্টডি পেপারে সাইন করতে। যাতে মেয়েকে স্কুল ছুটির এই সময়টায় সাথে রাখতে পারে বিদেশে। আমি দেখা করে সব সাইন করে দিলাম। বললাম মেয়েটার কিছু ছবি দিতে। অবাক করে দিয়ে আমাকে ছবি দিল মেইল করে। আমার প্রফাইলের ছবি টা সেটারই অংশ। আর বললাম মেয়েটাকে একবার দেখতে চাই। সেই তার বয়স যখন ৮ মাস। তখন দেখেছি শেষবার। আমাকে দেখা করাবে বলে মেয়েকে নিয়ে স্থায়ী ভাবে চলে গেল মালয়শিয়া। পুরো বিষয়টা আমি জানতাম আগে ভাগেই। কিন্তু ওই যে অদ্ভুত বোকা প্রেমিক আমি। মানুষের ছল করে বলা ভালো কথাগুলোও ভালো লাগে।
কিন্তু সমস্যা হলো রূপকথা লেখা হলো প্রেমের উপন্যাস লিখতে হবে। প্রতিদিন রাতে যখন একা হয়ে যাই। যে সময় আর গানও শুনতে ভালো লাগে না। যে সময়টা আমি শুধুই আমার, সেই সময়ে নিজের মেয়েটা জেগে ওঠে। নিশুত রাতে আমার মেয়েটা কেমন করে ঘুমায়! গায়ে কী চাদর থাকে! ঘুমের মধ্যে কি কথা বলে? হাসে? আমার মেয়েটার হাসি কেমন? তার প্রিয় গান কী? সে কী গান গায়! এইসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে কীবোর্ড ঝাপসা হয়। প্রেমের উপন্যাস আর অগ্রসর হয় না। আমি মনে হয় শুধু রূপকথা’রই জন্ম দিতে পারি। আর আমার সমস্ত প্রেমের নাম রূপকথা।