
Nazrul Islam | Photograph by Carlos Cazalis. Chairman Bari, Kurigram.
প্রথম দিকে আমার ধারনা ছিল যে ক্যানসার বড় অসুখ নয়। কেমো থেরাপি, রেডিও থেরাপি দিয়ে একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। খুবই সরল একটা ধারণা। বাবার যখন ক্যানসার ধরা পরল সেদিনটার কথা আমার মনে আছে। বড় ভয়ঙ্কর অনুভূতি।
ভারত এবং নেপালের মাঝে বেড়াতে গেছি। জায়গাটার নাম সান্দাকফু। ইনাম, জুই, ইনাম কন্যা, মনোয়ার ভাই এবং আমি। আমরা একটু বেশী এডভেঞ্চার করতে গিয়ে লালমনির হাট দিয়ে রওনা হই। তাই ফেরার সময় একই ইমিগ্রেশন। কুড়িগ্রামের কাছে তাই সুযোগটা হাতছাড়া করি নি। সবাই সহ বাড়িতে চলে যাই।
বাড়িতে গিয়ে দেখি আমার বাবা পিঠের ব্যাথায় ছটফট করছেন। তাই ঢাকা ফেরার সময় এক রকম জোড় করে তাকে নিয়ে আসি। আসতে চাচ্ছিলেন না। অনেক কাজ। চির জীবন কাজ করেই গেলেন। ঢাকায় এসে হাড়ের ডাক্তার দেখালাম। ওনার যাবতীয় এক্সরে এবং সিটি স্ক্যান শেষে বললেন বায়োপসি করাতে হবে। করানো হলো। সেই স্যাম্পল দুই জায়গায় দেয়া হলো। এক জায়গায় আসল ব্লাড ক্যান্সার এবং অন্য জায়গায় মেটাসটেসিস কার্সিনোমা।

My Father in front of his house with my sister Ruksi. Photograph taken by me.
যেহেতু দুই জায়গায় দুই রিপোর্ট তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো অনেকগুলো পরীক্ষা করা হলো। এবং অবশেষে জানা গেল যে তার ব্লাড ক্যান্সার নেই। তবে পরের টা নিশ্চিত। তখন আবার নতুন করে পরীক্ষা যে ক্যান্সারটির উৎপত্তি কোথায়। পরে জানা গেল ফুসফুসে। আমাদের আবার কান্নার রোল। জোয়ার ভাটার মতো অবস্থা।
আমি এবং মা গেছি রিপোর্ট আনতে মেডিনোভায়। পেট সিটি স্ক্যানের (PET CT Scan)। রিপোর্ট হাতে নিয়ে দেখি প্রাইমারি টিউমার ফুসফুসে। কাক তালিও ভাবে বাবা সেই সময়েই ফোন করলেন। এবং আমার মাকে তার জন্য সিগারেট আনতে বললেন। আমার মা রেগে আগুন। ফুসফুসে ক্যান্সার জেনেছেন মাত্র কয়েক মিনিট আগে। তার উপরে সিগারেটের আবদার।
বাসার এসেই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ। শুরু হলো কেমো এবং রেডিও থেরাপি। তারপরও মনে আশা। অনেক বেঁচে থাকবেন বাবা। এর পিছনে বড় শক্ত একটা যুক্তি ছিল। আমার নানী দীর্ঘকাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে ছিলেন। সেই ভরসায় আমাদের নতুন চিন্তা শুরু হলো।
দিনে দিনে বাবার শরীর খারাপ হওয়া শুরু করল। মাথার চুল হাওয়া। মুখে কালি। বড় কষ্টের সেসব দিন। এর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ মারা গেলেন। আমার স্মার্ট বাবা খুবই আপ সেট হয়ে গেলেন। তার যুক্তি “এত বড় মানুষ। এত ভালো জায়গায় চিকিৎসা করেও বাঁচালেন না। আমি কোথাকার কে?”।
আমি এবং মা আবার ঘটা করে ডাক্তারের কাছে গেলাম। আমার সকল আশাকে গুড়িয়ে দিয়ে ডাক্তার একটা বাজে কথা শোনালেন। এই ক্যান্সার মেটাসটেসিস। এটা হলে গড়ে ১ থেকে দেড় বছর মানুষ বাঁচে। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে অজ্ঞান হওয়া ঠেকালাম সেদিন। বাসায় এসে পুরো ভেঙে পরা একজন মানুষ। মাথার উপরের শক্ত ছাঁদ ভেঙে যাবে? আবার আমাকে শক্তও হতে হবে। নজরুল চেয়ারম্যানের একমাত্র পুত্র আমি। অনেক দায়িত্ব। অনেক কঠিন দায়িত্ব।
দেশের ডাক্তারদের কথায় আর ভরসা না পেয়ে একরকম রাতারাতি বাবাকে নিয়ে চলে গেলাম কলকাতা। টাটা মেডিকেল সেন্টারে। আবার একই চিকিৎসা। তারপর একদিন তিনি বৃদ্ধ হলেন, বনস্পতির ছায়া দিলেন সারা জীবন।
এই লেখা লিখতে পারছিলাম না। গত ২০ দিন থেকে চেষ্টা করেও শেষ হয় না। একটা লাইন লিখি। মনিটর দেখি না। ঝাপসা হয়ে যায়। লেখা শেষ হয় না। বড় কষ্ট। প্রতিটা দিনের কথা মনে পড়ে। বাবার মুখটা মনে পড়ে। আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্টার ছিলেন। আমার মুগ্ধ ভক্ত। আমার সব কিছুতেই যার অনেক গর্ব ছিল। সেই বাবাকে নিয়ে আমার লেখা থমকে থাকে। তারপরও লিখলাম। আবার লিখব।
আমি লিখব আমার রাত জেগে থেকে বাইরের সব বড় বড় মেডিকেল রিসার্স সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করা। টেস্ট মেডিসিনের চেষ্টা করা। এবং ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যান্সার নিয়ে পড়াশুনা করার কথা।

Humayun Ahmed | Photograph by Shakoor Majid.