এক.
রাত ৩:৪০ মিনিট। আজহার সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার। তাকে কেউ সময় বলে দেয়নি। কিন্তু তিনি খুব ভালো করেই জানেন এখন রাত ৩:৪০। গত দুই মাস ধরে কোন এক বিচিত্র কারণে তার এই সময় ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। অসময়ে ঘুম ভেঙে গেলে আজহার সাহেবের মন হাহাকার করে উঠে। খুব গল্প করার ইচ্ছে হয় কিন্তু উপায় থাকে না। জাহানারার ঘুম এই সময়ে ভাঙালে প্রচন্ড বিরক্ত হবে। যেদিন প্রথম ঘুম ভেঙে গেছিল সেদিন জাহানারাকে ডাকতেই খেই করে উঠেছিল। খুব দ্রুত জাহানারা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য কি বয়স দায়ী। ‘বয়সের সাথে সাথে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয়’ বিষয়ক একটা বই অনেকদিন আগে পড়া হয়েছিল কিন্তু এই মুহুর্তে কিছুতেই নামটা মনে করতে পারছেন না তিনি। খুব চিন্তিত হয়ে পরছেন, নিজের স্মৃতি এখন তাকে নিয়ে খেলছে এবং বার বার তিনি হেরে যাচ্ছেন। আজহার সাহেবের পানির পিপাসা পেয়ে গেল। অন্ধকারেই তিনি পানির গ্লাসের জন্য হাত বাড়ালেন। পানির গ্লাস নেই। এমনটা হওয়ার কথা নয়। নাকি এখানে পানির গ্লাস থাকার কথা নেই! তিনি বেড সুইস টিপে বাতি জ্বালালেন। না পানির গ্লাস আসলেই নেই।
-জাহানারা। জাহানারা। একটু উঠো তো।
-লাইট বন্ধ করো। এখন কয়টা বাজে?
-৩:৪০ (খুশি খুশি গলায় জবাব দেন আজহার সাহেব। স্ত্রীর এই প্রশ্নে তিনি বিগলিত)
-এত রাত্রে তুমি কি করছ? (গলায় বিরক্তি প্রকাশ পেল পুরোভাবেই)
-কিছুই না। ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। খুব পানি পিপাসা পেয়েছে।
-পানি পিপাসা পেয়েছে তো পানি খাও। আমাকে ডাকাডাকির তো কিছুই দেখতে পারছি না।
আজহার সাহেবের চেহারা মিইয়ে যায়। একটা সময় থাকে যখন মানুষের আর নৈত্তিক প্রয়োজন থাকে না। আজহার সাহেবের এখন সেই সময়ই চলছে বলে তিনি মনে করেণ। আজহার সাহেবের নিজের শরীরটাকে খুবই ভারী মনে হচ্ছে। তিনি তার শরীরটাকে টেনে টেনে ডাইনিং রুমের দিকে নিয়ে গেলেন। রাত ৩:৫০ মিনিটে দেখা গেল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবসর প্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব আজহার আহমেদ ফ্রিজ থেকে বরফ-শীতল পানি বের করে ঢক ঢক করে খাচ্ছেন।
দুই.
রূপকথাদের বাড়িটা বনানীর ১৭ নম্বর রোডে। পুরোনো ধাচের একটা দোতলা বাড়ি। যার কল্যাণেই হাউজিং কোম্পানিগুলোর নজর এখন ছয় কাঠার এই বাড়িটার দিকে। এই বাসাটা হচ্ছে এমন একটা বাসা যার সবকিছুই উল্টো নিয়মে চলে। যেমন সাধারণত বাবা-মা থাকে নীচ তলায় আর ছেলে-ছেলে বৌ থাকে উপরে কিন্তু এই বাসায় উল্টো। রূপকথার বড় ভাইয়া শান্ত ও তার সদ্যপরিণিতা লাবনী থাকে নীচতলায়। রূপকথার পাশের ঘরে। মেজ ভাই প্রাঞ্জল থাকে বাবা মার সাথে উপরে। রূপকথা এবার ঢাকা ভার্সিটেতে ভর্তি হয়েছে ভূগোলে। মেজভাই পাশ করেছে এক বছর হয়, এখনও কিছু করছে না। অবশ্য তার কিছু করার ইচ্ছে আছে বলে কেউ মনে করে না এই বাসার। রূপকথা ঠিক করেছে সে হিসেব রাখবে যে প্রাঞ্জল মাসে বাসায় কয়টা কথা বলে। যদিও প্রাঞ্জল রূপকথার ৬ বছরের বড় কিন্তু তাকে সে তুই তুই করেই বলে। আর বড় ভাইয়া শান্তু পুরোপুরি অশান্ত। সারাদিন বক বক করছে। অথচ খুবই ভালো চাকরি করে সে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে বাসার সব মানুষ তাকে এবং তার সদ্য বিবাহীতা স্ত্রীকে নিয়ে নানান রসিকতা করছে কিন্তু তারা বুঝতেই পারছে না।
আজ খুব ভোরে উঠেছে রূপকথা। অনেক ভোরে। আজ রূপকথার জন্মদিন নভেম্বর। কিন্তু তাকে এখনও কেউ শুভেচ্ছা জানায় নি। অবশ্য ঘটা করে জানানোর কোন কারণও নেই। সে যে একুশটি বছর শেষ করে ফেলল তাকে যতটা আলোড়িত করছে, আশপাশের কাউকেই তা স্পর্শ করছে না। রূপকথার মন বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। গলার কাছে কি যেন শক্ত হতে থাকে।
‘শুভ জন্মদিন’ বলেই সামনে বিশাল একটা ফুলের তোড়া রেখে দিল প্রাঞ্জল। রূপকথা বিস্ময় গোপন করতে পারেনা।
-ভাইয়া তুই একি করেছিস!
-তোর জন্য নিয়ে এলাম।
-তোকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া
জবাবে প্রাঞ্জল মিটি মিটি হাসতে থাকে। কিছু কথা বলে না। তার এমন ভাব রূপকথার জন্য যে কথার বাজেট ছিল তা বলা হয়ে গেছে। বাড়তি কথা বললে এর জন্য বাজেট ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এবং তা হয়ে গেয়ে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট্য কোন তদন্ত কমিটির কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে দিনের পর দিন। মিটি মিটি হাসিমুখ নিয়ে প্রাঞ্জল উপরে চলে যায়।
রূপকথার মনটা হঠাৎ করেই খুব ভালো হয়ে যায়। যাকে বলে ‘মেঘ না চাইতেই প্লাবন’ অবস্থা। আজকে সারাদিনের পরিকল্পনা তার মাথায় ছিল। তবুও আর একবার ঝালাই করে নেয় মনে মনে। প্রথম পরিকল্পনা মতো রূপকথার তার লেখার খাতা খুলে বসে। ‘আজ আমার একুশতম শুভ জন্মদিন’ এতটুকু লিখেই রূপকথা থামে। এবং সাথে সাথেই শুভ শব্দটি কেটে দেয়। আর লেখা এগোয় না। রূপকথা খাতা বন্ধ করে উপরে উঠে যায়। উপরে তার প্রিয় বারান্দা। যেখানে একটি দোলনা আছে। ছোটবেলা থেকেই রূপকথা দোলনায় দোল খেতে ভালোবাসে। তার বাবা আজহার আহমেদ খুব শখ করে কিনে এনেছিলেন এই বাহারী দোলনাটি। যা কিনে আনার পর রূপকথার মা জাহানারা বেগম স্বামীকে কথার বাণে রিতিমতন ‘ধোলাই দিয়েছিলেন’। সত্যিকার অর্থে তাদের বাসায় সেই সময় সেটাই ছিল সবচেয়ে দামী আসবাব।
দোলনায় দোল খেতে খেতে রূপকথা বাইরে তাকায়। দেখার মতন কিছুই নেই। শুধুই ইট-কাঠ মার্কা একটা পরিবেশ। তবুও আজকে তার দেখতে ভালো লাগছে। বাসার সামনে ক্যাবলটিভির তারে বসা কাকগুলোর তান্ডবও তার আজকে খারাপ লাগছে না। খারাপ লাগার কারণও নেই। আজকে একটি বিশেষ দিন। আজকে রূপকথার জন্মদিন। আজহার সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রূপকথার পিছনে এসে দাড়ালেন।
-কীরে মা। করছিস কি এত সকালে?
-কিছু না বাবা। কাক দেখছি।
-কাক আবার দেখার কি হলো?
-এমনি বাবা, দেখার কিছু নাইতো, তাই।
-তা ভালো। তবে কাক কিন্তু মোট ৬ প্রকার। যদিও আমাদের দেশে মাত্র দুই প্রকার কাক দেখা যায়।
-বাবা, তুমি তোমার ঔষধ খেয়েছো?
চেহারায় অন্ধকার নেমে আসে আজহার সাহেবের। তিনি ঔষধ খাননি। তাই তরিঘরি করে তিনি তার ঘরে চলে গেলেন। আর রূপকথাও হাপ ছেড়ে বাঁচল। আজহার সাহেবের জীবনের একমাত্র ধ্যাণ জ্ঞান হচ্ছে বই। এবং তিনি সুযোগ পেলেই তার জ্ঞান জাহির করতে বসেন। যা সবসময় হজম করা সুখকর নয় কারোরি জন্য। আজহার সাহেবকে রূপকথার খারাপ লাগেনা, তবে তার একমাত্র সমস্যা হচ্ছে সময় জ্ঞান। বাবার কোন ধারণাই নেই যে পৃথিবীর সব মানুষই ব্যাস্ত এবং সবারই নিজস্ব একটা জগত আছে। নিজের সেই জগতকে আবিস্কার করতে করতে মানুষ প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। রূপকথা অপেক্ষা করতে থাকে। ডাইনিং উপরের তলায় বলেই সবাইকে উপরে আসতে হবেই। তবে বড় ভাইয়ার কথা বলা যায় না। দেখা যাবে ঘরেই নাস্তা চেয়ে পাঠিয়েছে। বিয়ের পর ভাই সাধারণত নাস্তার টেবিলে আসে না খুব একটা। রূপকথার খুব ইচ্ছে দেখার যে ভাইয়া কেমন করে নাস্তা করে ঘরে বসে। নিঃ সন্দেহে একজন আর একজনকে অনেক ন্যাকামো করে খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করে কিংবা একজন আর একজনকে খাইয়ে দেয়। সকাল আটটা বাজতেই এক এক করে সবাই নাস্তার টেবিলে হাজির হল। জাহানারা বেগম অবশ্য রান্নাঘর থেকে বের হননি। বাসার পুরোনো বুয়াÑফরিদা বুয়াকে নিয়ে সকাল সাতটা থেকে তিনি রান্নাঘরে অবস্থা করছেন। তার একমাত্র মেয়ের আজকে জন্মদিন এটা তার মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। আজ নিয়মের ব্যাতিক্রম করে শান্ত ও লাবনী নাস্তার টেবিলে এসেছে। নাস্তার টেবিলেই এই বাসার প্রধাণ অধিবেসন হয় রোজ। সারাদিনের নানা কাজের কথা (যদিও তার ৭০ শতাংশই হয় অপ্রাঙ্গিক) এবং এই টেবিলেই সবাই একটু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। নাস্তার টেবিলে সবাই বসে আছে, শান্ত তার স্বভাবসুলভ একটানা কথা বলে যাচ্ছে আর প্রাঞ্জল শুনছে। লাবনী কিছু বলছে না তবে মুখ নিচু করে হাসছে মিটি মিটি করে। রূপকথা আজ কিছুই বলছে না, তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ একটি ফোনের জন্য। ফোন আসছে না কেন?
তিন.
সকাল বেলাতেই মনটা খুব উদাস থাকে আবিরের। ইদানিং এই রোগ ধরেছে। বিবর্তনের ধারায় প্রকৃতির সবচেয়ে বিস্ময়কর জীব মানুষ। কিন্তু আবিরের মধ্যে কিছুটা সমস্যা যাচ্ছে। সে বিস্মিত হবার চেষ্টা করছে, কিন্তু ইদানিং সে বিস্মিত হতে পারছে না। তার বিস্মিত হওয়ার স্থানে যোগ হয়েছে বিষন্নতা। ইদানিং ভবঘুরে একটা ইচ্ছে তৈরি হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না এর কারন কি? রূপকথার বাবাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে। এই যেমন এখন সকাল ৮:১০। সে দাড়িয়ে আছে মানিক মিঞা এভিনিউয়ের মাঝখানে। তাকিয়ে আছে সংসদ ভবনের দিকে। তার দাড়িয়ে থাকার মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু সে নিজেই জানে তার মধ্যে স্বাভাবিকতা বিরাজ করছে না। সে ক্রমাগত চোখ পিট পিট করছে। সামনের সংসদ ভবনসহ তার চত্তর অন্ধকার হয়ে আসছে। আবীর একটা গাছকে ধরে বসে পড়ল। ভাগ্যিস বিশাল মানিক মিঞা এভিনিউকে দুই খন্ড করা হয়েছিল, তাই রক্ষা। তার শরীর বেশ দুর্বল এখনও। কিছুদিন আগে তাকে হাসপাতাল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ‘ডেঙ্গু জ্বর’ নামের নতুন এক ধরনের উত্তাপ উৎপাদক ব্যাধি তাকে আক্রান্ত করেছিল কিন্তু বেশি সুবিধা করতে পারে নি। আবির থাকে ধানমন্ডি। আজ ঘুম থেকে উঠেই তার মনে হয়েছিল আজকে রূপকথার জন্মদিন। তাই সে বাধ্য হয়ে বের হয়েছে। তার কখনই সকাল বেলা বের হতে ইচ্ছে করে না। তার কোন কাজ নেই। একমাত্র কাজের লোকরাই সকাল বেলা ঘরের বাইরে যায়। সে যে কাজ করে তাকে কখনই তার জন্য সকালে বের হতে হয়নি এবং হবেও না। একটি আই এস পিতে (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার) রাতের শিফ্ট এ কাজ করে সে। যদিও কাজ করার কোন দরকার নেই, কিন্তু আবীর তবুও করছে। কাজ করছে সে তার বাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য। কতটুকু কাঁচামাল থেকে কি পরিমাণ সুতা হয় কিংবা কোন সুতা থেকে কি কোয়ালিটির কাপর হয় সেই হিসাবের চেয়ে কম্পিউটারে ভাইরাস বানানোর কাজ তার কাছে অনেক বেশি সহজ এবং আনন্দদায়ক। সে বুয়েট থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পাশ করেছে আর তার মধ্যে আছে প্রচন্ড কম্পিউটার প্রেম। এই দুইয়ের কল্যাণেই আবীরেরএই চাকরি। যদিও এর মধ্যে আবীরের বাবা নিয়ামত তালুকদার হালকা ভাবে বলেছেন যে তিনি নিজেই একটি আই.এস.পি দিতে চান। অবশ্য তার পক্ষে এটা বলা যতটা সহজ করা তার চেয়ে আরও সহজ। টাকার কোনো কমতি তার নেই। সে ভুলেই তার বাবার ফাঁদে পা দিবে না। আবীর ইদানিং প্রায়ই ভাবে মানুষ কেন পাখিদের মতন হলো না। বিভিন্ন ডালে ডালে ঘুরে বেড়ানো। ঘর বাধ আবার সেই ঘর ছেড়ে চলে যাও। অন্তত সেই সিস্টেমে তার বাবার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যেত।
আজকে যে সময় আবীরের ঘুম ভেঙেছে তাও নিয়মের ঘুম ভাঙা। এই সময় সে উঠে নাস্তা খায় এবং নাস্তা শেষ করে আবারও ঘুমিয়ে পরে। তার এটা অভ্যেস। ধানমন্ডিতে প্রাসাদতূল্য আবীরদের বাসাটাতে সদস্য সংখ্যা অপ্রতুল। সেই অপ্রতুলতাকে সমতায় এনেছে সামনের লেক। লেকের পানিতে সকালের কাঁচা সূর্যের কীরণ আবীরের রুমের ছাদে খেলা করে। আর সেই সময় সে আলোর খেলা দেখে। এটা তার শৈশব কালের অভ্যাস, হয়তো আরও আগের। আবীরের বর্তমান রুটিনের কল্যাণে বাসার অন্য সদস্যদের সাথে তার দেখা এবং কথা দুটোই খুবি কমই হয়। তাদের সময়ের পাল্লা এবং তার সময়ের পাল্লায় স্থায়ীভাবেই ওজনের কমবেশি। তাদের দেখা হওয়ার কোন লজিক নেই। আজকে কোন যানবাহনে উঠতে ইচ্ছে করছে না আবীরের। আজকে হাটবে। যতক্ষন হাটার মতন তার ক্ষমতা আছে। তবে এই হাটা সে শেষ করবে রূপকথাদের বাসার সামনে। আজ ৯ নভেম্বর। আজ তাকে যেতেই হবে। সে উঠে দাড়ায়। সাবধানে বিশাল রাস্তাটাকে ক্রস করে আবীর। সামনেই ভ্রাম্যমান খাবারের দোকান। দোকানের নাম ‘ইয়ান তুন খাইজান’। আবীরের মাথায় চট করে প্রশ্ন উঠল এই বিচিত্র চাইনিজ নাম কেন এই দোকানের? এ ধরনের নাম থাকবে তো বিশাল কোন চাইনিজ রেস্তোরায়। যে রেস্তোরার ভিতরে ঢুকলে নিজের চেহারাই বুঝা যাবে না অন্ধকারে। তারপর সেই অন্ধকারে স্যুপ হাতে নারাচারা করতে হবে। এবং কোন খাবার অবশ্যই হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাবে না। চাইনিজ খাবার হাতের স্পর্শে অপমানিত বোধ করে!
-ভাই, এই দোকানের নামের অর্থটা জানতে পারি?
-এটা একটা ‘চাটগাইয়া’ শব্দ। এর অর্থ এখান থেকে খেয়ে যান।
বিস্মিত হয় সে। এবং আরও বিস্মিত হয় এই ভেবে যে সে বিস্মিত হতে পেরেছে। কোন উদাসি রোগে ধরা মানুষ বিস্মিত হতে পারে না। আবীরের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়নি তাহলে।
-আপনার দোকানের সবচেয়ে কোন খাবারটা মজার?
-চটপটি খান। চটপটি গড়ম আছে। অবশ্য অন্য কোন কিছু এখনও তৈরি হয়নি। সবে মাত্র দোকান খুললাম। তবে আমার চালু আইটেম ফুচকা।
-ঠিক আছে। চটপটিই দিন দুই প্লেট। আমার প্লেটে ঝাল কম দিবেন।
দোকানের লোকটি চটপটি বানাতে লেগে গেল এবং জিজ্ঞেসও করল না আর এক প্লেট কার জন্য করতে বলা হয়েছে। এর মনে হয় বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষের কি বিভিন্ন পরিবেশে বিস্মিত হওয়া নির্ভর করে? রূপকথার বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এবং তার গুরুতর সন্দেহ ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত বিশাল একটা হাইপোথিসিস তৈরি করে ফেলবেন যার শেষটা অবশ্যই তথ্য সংগ্রহ পর্যন্ত গড়াবে। তবে আরও একটা সম্ভাবনা আছে, তা হলো রূপকথা তাকে রক্ষা করতে পারে।
চটপটি তৈরি হয়ে গেছে। তার সামনে ধোয়ায়িত দু’টি প্লেট। বেশ হলুদ হলুদ একটি ভাব। তবে তা রোদের জন্যই মনে হয়। সে প্রকৃতি প্রেমিক নয়। সে যন্ত্রপ্রেমিক। এই হলুদাভাব তাকে আকর্ষণ করল না। মে দোকানের লোকটিকে জিজ্ঞেস করে ‘ভাই আপনার নামটা জানতে পারি?’
-আমার নাম কাজল।
-কাজল সাহেব, আমার সাথে এক প্লেট চটপটি খেতে কি আপনার কোন আপত্তি আছে? আমার নাম আবীর।
কাজল কোন জবাব দেয় না। সামন থেকে চটপটির প্লেট উঠিয়ে নেয়। খাওয়া শুরু করে। তার মধ্যে নির্বিকার ভাব। আবীর বিস্মিত হয়। আজ পর পর দুবার বিস্মিত হবার ঘটনা ঘটল। জেনে শুনে বিস্মিত হওয়ার কোন উপায় থাকলে বেশ ভালো হতো।
-কত টাকা হলো?
-আবীর ভাই, টাকা দিতে হবে না। তবে একটা টাকা দেন। প্রথম কাস্টমার তো। প্রথম কাস্টমারকে তো আর ফাও দেয়া যায় না। আপনি সময় করে আর একদিন আইসেন। বিকেলে আসবেন। আপনাকে স্পেশাল ফুচকা খাওয়াব।
আবীর কিছুই বলে না। হাটা ধরে। তাকে বনানী যেতে হবে।
সংসদ ভবনের সামনে দশাশই পুরুষ রমণীরা দৌড়ের কসরত করছে যদিও তাকে একরকম পাছা দোলানি হাটার মতন মনে হচ্ছে। এবং পরুষদের হাতে একটা করে ছড়ি। আবীরের খুব জানার ইচ্ছে এই ছড়িটি নিয়ে কেন হাটা হাটি করতে হবে। ছড়ির সাথে দেহঘড়ির সম্পর্ক কোথায়? আজহার সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে হবে। সে আজকে পর পর বেশ কয়েকবার আজহার সাহেবের নাম মাথায় আনল এটাও খুব ভালো কথা নয়, সায়েন্স ফিকশনের ভাষায় এটা দশম মাত্রার অপরাধ। আজহার সাহেবকে এক রকম এড়িয়েই চলে সে। কিন্তু লোকটাকে খারাপ লাগে না। লোকটার মধ্যে আছে পরিচ্ছন্ন একটা দৃষ্টিভঙ্গি যা তাকে কাছে ডাকে। আবার ভদ্রলোক এত বেশি জ্ঞানের কথা বলেন যে তখন পালিয়ে বাঁচলেও শান্তি নেই।
আবীর র্যাঙ্গস এর মোড়ে যেতে না যেতেই খ্যাচ করে ব্রেক কষল একটি গাড়ি। গাড়িটা তারই। দাত কেলিয়ে রহমত মাথা বেড় করে।
‘ভাইজান আপনারে যাইতে কইছে।’ বলেই রহমতের হাসির স্পিড আরো বেড়ে যায়। আর এইদিকে তার বিরক্তি চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। কোন এক বিচিত্র ক্ষমতায় তার ড্রাইভার আজকে তাকে খুঁজে পেয়েছে। এতে অবশ্য তার বিরক্তির জন্ম নয়। বিরক্তির কারন হচ্ছে তার দিকে একপাল লোক উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যা তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না।
-আমি এখানে তুমি তা কেমন করে জানলে রহমত?
-আম্মায় কইল আপনারে খুইজা আনতে। আমি এইদিক দিয়া বেড় হইলাম। তয় আপনেরে এইখানে পামু তা ভাবি নাই।
-রহমত তুমি আমাকে পাও নাই। তোমার আম্মাকে (আবীরের মাকে রহমত আম্মা ডাকে) বলবে আমাকে কোথাও পাওয়া যায় নাই।
বলেই আর ফিরেও তাকায় না আবীর সামনে হাটা ধরে। হঠাৎ তার মনে হল তার ড্রাইভার আবার যুধিষ্ঠির গোত্রের। এ ব্যাটা তো সত্যি কথাটাই গিয়ে বলে দিবে। সে দ্রুত গাড়ির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে রহমত তার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আসন্ন পরিস্থিতি বিচার করার জন্য মোটেও সময় ব্যয় করে না সে অবশ্য ইচ্ছেও নেই। সে এগিয়ে যায়।
সে যখন রূপকথাদের বাসার সামনে পৌছল তখন বেলা ১২ টা, কাটায় কাটায় ১২ টা। আবীর যেই বেল দিতে যাবে তখুনি প্রাঞ্জল দরজা খুলে বের হয়। আবীরকে দেখে কিছুই বলে না।
-কিরে খবর কি তোর?
প্রাঞ্জল জবাব দেয় না , হাসে। অনেকটা নতুন জামাইয়ের মতন, সঙ্কোচমাখা হাসি। যা দেখে আবীরের বিরক্তি বেড়ে যায়। প্রাঞ্জল তার স্কুল বন্ধু এবং একমাত্র বন্ধু।
-আমি তোর গলার আওয়াজ শুনতে চাচ্ছি, একটু কথা-তথা পাস্ র্কনা আব্বা।
-তুই এসময় কি মনে করে? সব খবর ভালো তো?
-কেন তুই কি কোন মন্ত্রীর শালা হয়ে গেছিস নাকি, যে তোর বাসায় আসতে এপয়নমেন্ট নিয়ে আসতে হবে?
প্রাঞ্জল কোন কথা বলে না। তবে ঘরের ভিতরে ঘুকে যায় এবং আবীরের গৃহপ্রবেশের জন্য অপেক্ষা করে। আবীর ভিতরে ঢুকে। ভেতরে রূপকথা সোফায় বসে আছে। তার সামনে কলকাতার দেশ পত্রিকা খুলে ধরা। চোখে চশমা। চশমাটা আগে সে দেখেনি। কালো কার্বনফ্রেমে চশমাটা ভালোই মানিয়েছে তাকে।
-কি রূপের কথা, খবরা খবর কোন চ্যানেলে?
-আপনাকে আমি কতবার বলেছি যে আমাকে ঐ নামে ডাকবেন না।
রূপকথা আরও অনেক কিছুই বলত, কিন্তু আজ সে কিছু বলবে না। আজকে তার জন্মদিন। এমনিতেই আবীরের সাজসজ্জা তার পছন্দ হয়নি। মানুষটা কি আজকে ইচ্ছে করেই অমন কাপড় পরে এসেছে! মনে হয় ঘুম থেকে উঠে আর কাপড় ছাড়ে নি।
-ভার্সিটির খবর কি? পোলাপান কি হরতাল-ফরতাল ভুলে গেল? হরতাল ছাড়া তারা পরাশুনা কেমন করে করে ?
-ভার্সিটির খবর ভয়াবহ। তবে আপনার হরতাল প্রীতির কারণটা কি?
-না এমনি জিজ্ঞেস করলাম, কথার কথা আরকি।
-আমি কথার কথা পছন্দ করি না। কথার প্রয়োজনে কথা বলা এক ধরনের মিথ্যাশ্রয়তা।
এই কথাটা বলেই রূপকথা চুপ করে যায়। কথাটা রূপকথা আজহার সাহেবের কাছ থেকে শিখেছে। তার বাবার কথা তার মধ্যে ইদানিং প্রভাব ফেলছে। রূপকথা বেশ কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছে তাকে ভার্সিটির বন্ধুরা একরকম এড়িয়ে চলছে। কারনটা রূপকথা বের করতে পারছে না। রূপকথা কি ভার্সিটেও তার বাবার মতন কথা বলছে!
-শুভ জন্মদিন। আমি উপরে যাচ্ছি।
রূপকথা চমকে আবীরের দিকে তাকায় কিন্তু ততক্ষণে সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছিল। রূপকথা আর কিছুই বলতে পারে না। বিষাদময়তা তাকে গ্রাস করে ফেলছে।
চার.
দুপুর বেলাটা আজহার সাহেবের জন্য ভয়াবহ একটা সময়। এই সময় বাসায় জাহানারা বেগম ছাড়া আর কেউ থাকে না। আর জাহানারা বেগম থাকাও যে কথা না থাকাও সে কথা, একটা কথাও ঠিকমতোন বলেন না তিনি। আজহার সাহেব খুব উসখুস করেন কথা বলার জন্য। নতুন কি পড়ে জানলেন তা বলার জন্য, তার মতামত কী তা শেয়ার করার জন্য কিন্তু কিছুই হয় না। তাই এই সময়টাতে তিনি লেখার চেষ্টা করেন। তবে তার লেখা কোনটাই বেশি একটা গড়ায় না। তিনি এতো দ্রুত চিন্তা করেন যে তার সাথে হাত পেরে উঠে না। তাই তিনি লেখা লিখি কিছুক্ষণের মধ্যে চুকিয়ে দিয়ে বসে থাকেন। এটাই রিটায়ার্ড করার পর থেকে তিনি করে আসছেন। বাসার কোন কিছুর ব্যপারে তার আগ্রহ বরাবরের মতন খুবই কম। তাই কোনদিন তাকে বাজারে যেতে হয় না। তাকে কেউ ফোনও করেন না , তিনিও কারও খোঁজ করেন না। একদম ডোমেসটিক। তবে আজকে আবীরকে দেখে তিনি ঝিকমিকিয়ে উঠলেন। আরও খুশি হলেন দেখে যে আবীর দোতলায় উঠছে। তিনি সিঁড়ির গোড়ায় দাড়িয়ে রইলেন।
‘আবীর, ইয়াংম্যান, মানুষের ব্রেনের সাথে কম্পিউটারের কোন ইন্টারফেস তৈরি হলো?’ জবাবে আবীর সুন্দর করে হাসি দেয় একটা। এই বিশেষ ধরনের হাসি তাদেরকে শেখানো হয়েছিল বিজনেজ কমিউনিকেশন নামের ৩ ক্রেডিট আওয়ারের একটা সাবজেক্টে। যেখানে পড়ানো হয়েছিল কাস্টমার খারাপ হোক ভালো হোক সবসময় মুখ হাসি হাসি করে রাখতে হবে। আবীর এখন একজন ‘খারাপ’ কাস্টমার সামলাচ্ছেÑহাসি হাসি মুখ করে। তার হাসি দেখে আজহার সাহেবের আকর্ণ বিস্তৃর্ণ অবস্থা। আবীরের হাত ধরে তার ঘরে টেনে নিয়ে যান তিনি। আর পুরো ব্যপারটা মিট মিট করে দেখে প্রাঞ্জল। ‘বুঝলে বাবা, বয়স বাড়ার সংগে সংগে মানুষের পরিবর্তন খুব দ্রুত হয়ে যায়। যাকে বলে র্যাপিড চেঞ্জ।’ আজহার সাহেব বলেন। ‘তাই নাকি? হুম্ মজার কথা’ আবীর জবাব দেয়। ‘এটা তোমার কাছে মজার কথা মনে হচ্ছে? তুমি তো এখনও শুনলেই না পরিবর্তন গুলা কোথায়। আর তাতেই তুমি মজা পেয়ে গেলে। না ইয়াংম্যান তোমাদেরও ধৈর্যশক্তির অবনতি হচ্ছে। তাহলে কী বয়স কোন ঘটনা না।’ শেষের বাক্যটা একটু আস্তে আস্তে উচ্চারণ করেন আজহার সাহেব। ‘খালুজান, বয়সের সাথে ধৈর্য নিয়ে কিছু হয়েছে কী?’ আবীর বলে। ‘হয়নি আবার! যেমন ধরো তোমার খালা, সারাদিন আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করছে, কোন ভাবেই আমাকে হেল্প করছে না, এটা বয়স বাড়ার সাথে সাথেই ঘটছে।’ আবীর জবাব দেয়ার আগেই রূপকথা নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকে। আবীর এবং আজহার সাহেব মনযোগ টেবিলের উপর আবদ্ধ করেন। এর পর চা দিয়ে যায় বুয়া। রূপকথা বাবার পাশে বসে। ঘটনাক্রমে আজকের চা খুবই খারাপ হয়েছে যা এই বাসার সংবিধান পরিপন্থি। চা মুখে দিয়েই আজহার সাহেব দিলেন এক হাক ‘কী হলো আজকে চায়ে! মুখেই তো দেয়া যাচ্ছে না, চা দিয়ে কী ওজু করতে হবে নাকি?’। কোন কিছু দিয়ে ওজু করাÑকথাটা আজহার সাহেবের মুদ্রা দোষ। এই মুদ্রাদোষ হওয়ারো একটা কারণ আছে। একবার তাদের গ্রামে এক মৌলানা সাহেব বেড়াতে এসেছিলেন। খুব নাম ডাক ছিল তার। বাড়িতে আসতেই বেশ সাড়া পরে গেছিল। কোথায় বসতে দেবে, কী খাবে ইত্যাদি নিয়ে চিন্তার শেষ নাই। যখন খেতে দেয়া হলো তখন তিনি ওজু করবেন বলে বাইরে বের হলেন। বাইরে বের হতেই তার চোখে পরল পানি একটা জগ। তিনি চমৎকার করে ওজু করলেন। হুজুরের চোখের অবস্থা ছিল বেশ কাহিল। ভুলে তিনি পানির জায়গায় দুধ দিয়ে ওজু শেষ করেছিলেন। বাড়ির মানুষজন সেই পরক্রমশালী হুজুরকে কিছু বলেনি এই ভেবে যে তিনি বোধ হয় দুধ দিয়েই ওজু করেন। অবশ্য সেই দুধ ওখানে থাকার কারণও ছিল না। যে লোককে বাজারে পাঠানো হয়েছিল দুধ আনানোর জন্য তার দুধ আনা হতেই তার তলব পরে হুজুরের পা টেপার জন্য তাই তিনি দুধ বারান্দায় রেখে তরি ঘরি করে ছুটে যান ঘরের মধ্যে। আর সেই সূত্র ধরেই বিপত্তি। সেই ঘটনার পর থেকে আজহার সাহেবের এই কথার বদভ্যাস।
চা নিয়ে হৈ চৈ এর অবসান ঘটালেন জাহানারা বেগম। এই কাজটা তিনি দীর্ঘদিন থেকে দায়িত্বের সাথে করে আসছেন।
(চলবে. যদি পাঠক কিছু বলেন)