রাজনৈতিক পরিবারে মানুষ হওয়ার পরও কখনো জনগণের সামনে ভাষণ দিতে হয় নি। আমি ঠিক পছন্দ করতাম না। তবে জীবনে দুইবার আমাকে অনেক মানুষের সামনে কথা বলতে হয়েছিল। কথা বলতে হয়েছিল মাইকেই। প্রথমবার প্রায় ৬ বছর আগে আমার বাবার জানাজার দিন এবং শেষবার কয়েকদিন আগে আমার চাচার জানাজায়। বাবার জানাজা ছিল জনসমূদ্রের। দ্য গ্রেট নজরুল চেয়ারম্যানের জানাজা বলে কথা!
আশ্বর্য হলেও সত্যি দু’টি দিনেই আমি খুব গুছিয়ে কথা বলেছি। আমি পরিবারে পরের জেনারেশনের মধ্যে সবার বড়। এখন চাচার মৃত্যুর পর দুই পরিবারেরই বড়। কী অদ্ভুত! দেখতে দেখতে বয়স এখস চল্লিশ ছুঁইছুঁই করছে! অথচ মনে পড়ছে সেদিনই তো আমার চাচা ফুলকুমার নদীর পাড়ে আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন!
আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখাটা কোন নির্মমতা নয়। আমি শৈশবে অসম্ভব দূড়ন্ত এক শিশু ছিলাম। যন্ত্রপাতির উপর ছিল আমার অনেক আগ্রহ (এই আগ্রহ একবিন্দু কমে নাই এখনো)। আমার চাচার ছিল অনেকগুলো পানি তোলার মেশিন। ইঞ্জিন চালিত সেইসব মেশিন ডিজেলে চলত। আমার কাজ ছিল সেইসব মেশিন চলন্ত অবস্থায় পর্যবেক্ষণ করা। আমার বিজ্ঞানী মন, কিন্তু অভিভাবকদের কাছে এই মানসিকতা আতঙ্কের অপর নাম। ২৪ হর্সপাওয়ারের একটা মেশিন একটা শিশুকে পিষে ফেলার জন্য যথেষ্ট। চাচা যখন সাথে থাকতেন আমাকে নজরে রাখতেন কিন্তু বাইরে গেলে আমাকে দড়ি দয়ে বেঁধে রেখে যেতেন যাতে মেশিন না ধরি (বেশ কয়েকবার মেশিন বন্ধ করে দিয়েছিলাম)।
পরিবারে প্রথম জন্ম নেয়ায় কিছু জন্মগত অধিকার নিয়ে বাঁচতে হয়। এর একটি হচ্ছে আদর-স্নেহ। আমার এক চাচা আর আট ফুপুর কাছে যে আদর পেয়েছি, এই সময়ে সেটা ভাবলে রূপকথা মনে হবে। চাচার মৃত্যুর দিন ছয় ফুপুর সাথে দেখা এক সাথে অনেক দিন পর। বাকী দুই ফুপু মারা গেছেন। এই বয়সে এসেও আদরের কোন কমতি নেই আমার!
আমার বাবা এবং চাচা দুজনেই হুমায়ূন আহমেদের নাটক থেকে উঠে আসা জীবন্ত চরিত্র ছিলেন। চাচাকে তো এলাকায় সবাই পাগলা বলেই ডাকত। বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড করতেন। এবং তাঁর যুক্তিগুলো ছিল খুবই মজার।
আজ চাচা নেই। বাবাও নেই। কিন্তু ফুলকুমার নদী আছে। এই নদীতে চাচা আমাকে গোসল করতে নিয়ে যেতেন। গায়ে সাবান মাখিয়ে বেশ দলাইমথলাই করে গোসল দেয়াতেন। আর আমি চোখ বড় করে আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম দেখার জন্য কখন আমার চামড়া তার হাতের সাথে উঠে আসে। সারাদিন যন্ত্রপাতি নিয়ে থাকা মানুষটার হাতও ছিল লোহার মতোন শক্ত। আমার যন্ত্রের উপর আসক্তি মনে হয় চাচার থেকে পাওয়া।
চাচার দায়িত্ব ছিল পারিবারিক সব জমিতে চাষ করানোর। তাই আমাদের বাড়ির একটা ঘর ছিল রাসায়নিক সারের গোডাউন। চাচাকে দেখে শৈশবে একদিন খুব কৃষিকাজে মনোযোগি হলাম। বাড়ির আঙিনার এক পাশে কুপিয়ে কুপিয়ে কয়েক বর্গফুট জমি বানিয়ে ফেললাম। আমি কৃষিকাজ করছি আর বাড়ি সবাই মজা পাচ্ছে। আমার মেহনত আর তাদের বিনোদন! জমি চাষ শেষে পানি দেয়া হলো (এক বালতি পানিতে আমার ক্ষেত ভরে গিয়েছিল)। তারপর সেই জমিতে ধান লাগিয়ে দিলাম। ধান লাগানোর পরেই দিতে হয় সার। চাচার সারের আস্তানায় গিয়ে সার নিয়ে এসে দিলাম সেই জমিতে। সার দিতে হয় জানতাম, কিন্তু কতটুকু দিতে সেটা তো জানি না। কিছুদিনের মধ্যে আমার সোনার ধানগাছ মরে গেল।
আমি কয়েক বর্গফুট জায়গায় কয়েক বিঘা জমির পরিমাণ সার দিয়ে ফেলেছিলাম। এই তথ্য জানার পরেও মমতার কারণে আমাকে চাচা না করেন নাই। পরে অবশ্য জমির সব মাটি উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার জমিতে দিয়েছিলেন। সেই ছিল আমার প্রথম এবং শেষ কৃষিকাজ।
চাচার স্মৃতিগুলো সবুজ ধানগাছের সাথে বেঁচে থাক।
**//** ধানমন্ডি, ঢাকা।