আমাদের গ্রামে বেশ কিছু গরীব প্রতিবেশী ছিল। শৈশবে মনটা এখনকার মতো ক্লাসি ছিল না, তাই বেশীরভাগ খেলার সাথীই ছিল গরিবদের বাচ্চাকাচ্চারা। কিছুদিন পরে সেই বাড়িগুলো অন্যত্র সরিয়ে ফেলল; তাদের অবস্থা একটু উন্নতি হয়েছে ততদিনে। উন্নতি মানেই নিজের অবস্থান একটু শক্ত করার চেষ্টা, নিজস্ব একটা পরিবেশ খুঁজে নেয়া। হুট করে অনেকগুলো খেলার সাথী কমে গেল। যদিও বর্তমান সময়ে সেই বাড়িগুলো যথেষ্ট কাছেই কিন্তু শৈশবে সেগুলোকেই মনে হতো কত না দূর! একা যেতে পারতাম না। সাথে সঙ্গীসাথী নিয়ে যেতে হতো। খেলা তবু থেমে থাকে নি। আমরা অপেক্ষা করতাম কখন সূর্যটা একটা হেলে পড়ে। যতক্ষণ খালি চোখে ফুটবল চোখে পড়ত, আমরা খেলতাম। কীসের নব্বই মিনিট আর কীসের হাফ টাইম! শরীর ছিল লিকলিকে। এখন চিন্তা করতে রূপকথার গল্প মনে হয়!
প্রতিবেশীদের তৈরি করা নতুন বাড়িতে একদিন আগুন লাগল। আগুন মানেই আতঙ্ক, আগুন মানেই ভয় কিন্তু এর আগে কখনো বাড়িতে আগুন লাগা দেখিনি। অনেক উত্তেজনা। আমাদের বাড়ি থেকে সেই আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছিল। সময়টা ছিল খেলা শুরু হওয়ার সময়। এত উচ্চতায় আগুনের লকলকে শিখা আগে কখনও দেখা হয় নাই। ঘরগুলো ছিল খরের, পাটকাঠির; আগুনের বেড়ে ওঠা ছিল অবধারিত। কিন্তু সংগ্রামি মানুষেরা সেই আগুনকে আয়ত্বে নিয়ে এসেছিল দ্রুতই। ততক্ষণে পুড়ে সব শেষ। আমার মন খারাপ। উত্তেজনা নেই। তার থেকে বড় কথা খেলা নষ্ট হয়ে গেছে সেদিনের।
আগুন নিভে এলে খোঁজ পড়ল এক শিশুর। কোথাও সেই শিশুকে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ ঠিক ভষ্ম হয়ে যাওয়া ঘরে খুঁজতেও চাচ্ছে না। সবখানে খুঁজে না পেয়ে নিভন্ত আগুনের মাঝে খোঁজা শুরু হলো। শিশুটির কয়লা হয়ে যাওয়া শরীর বেড় করে আনা হলো ছাইভষ্ম থেকে। মনে আছে একটা বাঁশের মাথায় আড়াআড়ি করে আর একটা বাঁশ দিয়ে বেশ ফাঁদ তৈরি করে শরীরটা টেনে আনা হয়েছিল। আমার চোখের সামনে দিয়ে আসা প্রথম অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশ। প্রথম বিভৎস দেহ দর্শন।
শিশুটির নাম ছিল “আয় সুতি” এর মানে হল Let’s Sleep. আপাতভাবে বেশ অশ্লীল এবং আদিরসাত্মক একটি নাম। কুড়িগ্রামে বাচ্চাদের নামকরণের আগে এই রকম অদ্ভুত সব নাম দিতেন মূলত শিশুটির দাদা বা নানা। নাতি-নাতনীদের সাথে এইসব রসিকতা করা একধরনের গ্রামীণ মজা। আয়সুতি’র কয়লা হয়ে যাওয়া শরীর দেখে প্রথববারের মতো ভয়ে রাতে ঘুম হলো না। আমার বয়স তখন সম্ভবত ৭। সারারাত কাঁপতে কাঁপতে মা’কে জড়িয়ে ধরে ছিলাম।
যে আগুনের শিখা দেখে অনেক লাফালাফি করলাম, সেই আগুনের পরিনতি ঠিক আর ভালো লাগল না। সবার মাতম, পরাজিত মানুষের মুখ আর একধরণের ক্রোধ দেখে আমার শৈশবের পৃথিবীতে একটা বড় ধরণের দাগ তৈরি করল। সেটাই ছিল জীবনের প্রথম আগুনে সবকিছু পুড়তে দেখা। শিশুটির লাশ যখন টেনে আনা হচ্ছিল, গ্রামের সবাই এক সাথে চিৎকার করে উঠেছিল। সমবেত চিৎকারে ঠিক কার কাছে ক্রোধের সমন্বয় করেছিল, সেই বয়সে বুঝতে পারছিলাম না।
এরপর যতদিন গ্রামে ছিলাম, আয়সুতি’র মা’কে কখনো হাসতে দেখিনি। যতবার তার মুখের দিকে তাকিয়েছি, একটা কয়লা হয়ে যাওয়া বাচ্চার ছবি বারবার ফিরে এসেছে মনে।
পরিতোষ সেনের জিন্দাবাহার এবং অন্যান্য বইয়ে আগুনের অদ্ভুত কিছু বর্ণনা পড়েছি। আগুনের সৌন্দর্য নিয়ে বা ভালোবাসা নিয়ে এমন ভাবে আর কেউ মনে হয় লেখেননি। মানে আমার পড়া হয় নাই। এই বই পড়ার পর থেকে আগুনকে খুব আর কষ্টের মনে হতো না। আগুনের শক্তি বা আগুনের রূপের সাথে সেটাই ছিল প্রথম পরিচয়।
ম্যাক্সিকান ফটোগ্রাফার বন্ধু কার্লোস কাজালিস সহ কুড়িগ্রামে গিয়েছিলাম ছবি তুলতে। বিষয় ছিল ক্লাইমেট চেঞ্জ। ছবি তুলে ঢাকায় ফিরে আসি ২৩ নভেম্বর, ২০০৯। ঢাকায় এসেই শুনি গতকাল ঘটে যাওয়া মগবাজার বস্তির আগুনের ভয়াবহতার খবর। বিলম্ব না করেই সরাসরি সেই স্পটে দু’জনেই হাজির। সেই দৃশ্য দেখে এলো মেলো হয়ে গেলাম। একটা বাড়িও অবশিষ্ট নেই। সব একেবারেই ছাই। বোঝার কোন উপায় নেই এখানে প্রায় ৫০০০ লোকের বাড়ি ছিল। আগুনের শক্তি দেখে একরকম বাকরুদ্ধ। অনেক ছবি তুলে বাসায় ফিরে এলাম। আসার সময় আমার আর কার্লোসের আর ঠিক কোন গল্প হয়ে ওঠে নি। বিষাদে ছেয়ে গেছে যতদূর যাই!
এরপর অনেক আগুনের খবর পড়েছি, দেখেছি। কিন্তু কত ভয়াবহ হতে পারে সেটা আর কল্পনা করতে সমস্যা হয় নি। এই যে কয়েকদিন আগে যখন বননীতে আগুন লাগল, ৯/১১ এর মতো মানুষজন সুপারম্যানের মতো পড়ে মরল, সব দেখলাম। কী করার আছে! আগুনের আবিষ্কার ছিল সভ্যতার প্রথম সূচনা। এই আগুন একই ভাবে অসভ্যতারও প্রথম জন্মদাতা।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আগুন নিয়ে খেলতে নেই। অথচ কেমন খেলার ছলেই নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো। আগুনের পুড়ে মারার এই চল এই উপমহাদেশে নতুন নয়। সেই সতীদাহের যুগ থেকে আমরা এটা এনজয় করেই এসেছি! কিন্তু সেই রাবণও নেই, নেই সেই লঙ্কাও। কেমন করে যেন মনটা সেই ছোটবেলায় দেখা কয়লা হয়ে যাওয়া বাচ্চাটার সাথে আটকে আছে। তাই বারবার নুসরাতের ছবিটা দেখছি। গভীর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকছি। মাত্র কয়েকটি দিন আগেও সেই চোখে স্বপ্ন ছিল, ভালোবাসা ছিল, মমতা ছিল। ২০১৯ সালে আমরা সেই মেয়েটিকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছি। মাত্র দুই বছর পর আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি। খুব অদ্ভুত ভাবে, স্বাধীনভাবে এই লেখাটা লেখার সময় আমি কাঁদছি। এবং স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি পুরো দেশ কাঁদছে। সেই ছোটবেলায় যেমন করে গ্রামের সবাই একসাথে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল, সেই রকম।
নুসরাত সারা বাংলাদেশের কাছে, সারা পৃথিবীর কাছে বলেছিল এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। আমি এই কাজটা করব। আমার জায়গা থেকে খুব স্পষ্টভাবেই করব।
**//** ধানমন্ডি, ঢাকা।