আমার দুর্নাম অনেক। সামাজিক আচার আচরণ ভালো বুঝি না। মানে ঠিক জায়গায় সঠিক কথা বলতে সমস্যা হয়। আর এজন্য বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। যেমন কয়েক দিন আগে এক রকম কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। কেলেঙ্কারি যে হয়ে গেছে তা বুঝতে অবশ্য কিঞ্চিত বিলম্ব হয়ে গেল। ভূমিকা রেখে মুল ঘটনায় আসি।
ঘটনা বেশ কয়েক বছর আগের। নাট্যকার হিসেবে আমার একটু নামডাক হয়েছে। অনেকেই চেনে সেই কারণে। একটা কাজের সুবাদে এক নায়িকার সাথে আলাপ হলো। আলাপ থেকে বেশ সখ্যতাই হয়ে গেল। গল্পের খাতিরে ধরে নিচ্ছি নায়িকার নাম নন্দিতা। সেই সময় নন্দিতা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এমন সুন্দরী একটা মেয়ে আমার বন্ধু ভাবতে খুব খারাপ লাগে না। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে ফেসবুক কেন্দ্রীক ব্যবসা বা F-Commerce এর রমরমা উত্থান। ঘরে ঘরে সবারই ফেইসবুক পেইজ আর সবাই তখন উদ্যোক্তা যাকে বলে Entrepreneur. আমার গল্পের নায়িকাটিও পিছিয়ে থাকবেন কেন? উনিও ফেসবুক পেজ খুললেন।
সবাই যেখানে অন্যকে সাজানোর জন্য ব্যস্ত, উনি মনযোগী হলেন ভিতরের দিকে। যাবতীয় অন্তর্বাস নিয়ে তার পেইজ। ছেলেদের জাঙ্গিয়া থেকে শুরু করে ব্রা, প্যান্টি নিয়ে তার বিশাল কারবার। ব্যবসা কেমন হচ্ছে তা জানি না তুবে প্রতিদিন তিনি খুব যত্ন করে পরিশ্রম করে পোস্ট দেন। কখনো দেখা যাচ্ছে প্যাকেজিং করছেন আবার কখনো দেখা যাচ্ছে মার্কেটে ঘুরছেন আইটেম সোর্স করার জন্য। মোট কথা বেশ এলাহি একটা আয়োজন। বেশ দর্শনীয়ও বটে! প্রতিটা পোস্টে যে পরিমাণ লাইক আর শেয়ার তার থেকে শতকরা ৫ জনও যদি কেনাকটা করে নন্দিতার কোটি টাকার বিক্রি হওয়ার কথা। আমার ভাবতে বেশ লাগল।
তার এই আইডিয়া আমার পছন্দ হলো। আমার পরিচিত কারো এই ব্যাবসা ছিল না। আমি উৎসাহ দিতে তাকে ফোন করে অনেক পজিটিভ কথা বলে ফেললাম। সেও খুশিতে গদগদ। আমাকে অধিক খুশিতে একটি জাঙ্গিয়া পাঠানোর কথা জানালেন। আমিও রাজি হলাম। সুন্দরী একজন নায়িকার কাছে জাঙ্গিয়া কেন, বিষ আনতেও খুব বেশী আপত্তি আমার থাকার কথা না। কবে পাঠাবে তা আমি জানাব বললাম। যখন কথা হচ্ছিল, অফিসের কাজে আমি বরিশালে। ঢাকায় এসে স্বভাব সুলভ ভাবে ভুলে গেলাম জাঙ্গিয়ার কথা। এরপর চলে গেল প্রায় তিন বছর।
এই তিন বছরে অনেক কিছু ঘটে গেল। আমি নতুন জায়গায় চাকরিতে যোগ দিলাম। আমার বাসা বদল হয়ে গেল। মিরপুর থেকে এখন আমি মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা। একদিন নন্দিতার হঠাৎ ফোন।
-হ্যালো সাব্বির ভাইয়া, কেমন আছেন?
-ভালো আছি। তোমার কী খবর?
-আমার আর খবর! সাব্বির ভাইয়া আপনি তো জাঙ্গিয়াটা নিলেন না। আমি আর কতদিন সেটা রেখে দিব!
-কোন জাঙ্গিয়া বল তো?
-আরে ওই যে, আমার পেজ থেকে কিনতে চাইলেন না! জানেন আমার পেজটা হ্যাক হয়ে গেছে। আমি এখন আর সেই ব্যবসা করি না। সব শেষ। যা ছিল সবাইকে গিফ্ট করে দিয়েছি। এক কাজ করেন না, আগামী ১৫ ডিসেম্বর আমার বিয়ে। চলে আসেন না ভাঁইয়া। আমি জাঙ্গিয়াটাও দিয়ে দিব। ঘরোয়া অনুষ্ঠান। শুধু পারিবারিক লোকজন থাকবে।
আমি আসব বলে ফোন রেখে দিলাম। নায়িকারা কখন যে ভাইয়া ডাকে আর কখন ভাঁইয়া এই হিসেবটা এখনো মিলাতে পারলাম না।
আমার সামাজিক অনুষ্ঠানে অরুচি তাই তার বিয়েতে যাওয়া হলো না। সেই জাঙ্গিয়া আর আনাও হলো না। মাঝে মাঝে বরের সঙ্গে তার ছবি দেখি। লাইক দেই, কমেন্ট করি। ভার্চুয়ালি যোগাযোগ অমলিন।
গত কয়েক দিন আগে আমার বান্ধবী বলল সে সালাদ খাবে। খুব ভালো কথা। আধুনিক মেয়েরা ঘাস-লতাপাতায় ফেরৎ যাচ্ছে, ভাতের উপর চাপ কমছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসছে। বান্ধবীর আবদার। তাই উপায় নেই। তার সাথে যেতে রাজি হলাম গুলশানে।
গুলশান দুই নম্বারের সেই রেস্টুরেন্টটাও একটা বিভীষিকা। গাড়ি নিয়ে ঢোকার পথ আর বেরোনোর পথ আলাদা। বেশ চক্রাকারে ঘুরার মতো একটা বিষয়। যখন এই চক্রে ঢুকে গেলাম মাথায় আসল যদি সাতবার ঘুরতে পারি তাহলে সাতপাকে বাঁধা পড়ে যাবার মতো একটা বিষয় হবে। তখন কী আমাকে আজীবন ফ্রি খাওয়াবে? বান্ধবীর ধমকে গাড়ি থামিয়ে পার্ক করতে হলো।
সুন্দর গোছানো রেস্তোরাঁ। বেশ আরাম করে খেয়ে যখন গাড়িতে উঠেছি, সেই নায়িকার ফোন।
-হ্যালো।
-হ্যালো সাব্বির ভাইয়া। আপনি কি গুলশানে?
-হ্যাঁ।
-আপনি একটু দাড়ান। আমি আসছি। আমিও সালাদ খেতে এসেছি। আপনার পিছনেই ছিলাম কিন্তু বুঝতে পারি নি।
আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি। নায়িকা বর নিয়ে হাজির। দেখে বেশ ভালোই লাগল। সুন্দর ছেলে। বেশ লম্বা।
-কেমন আছ নন্দিতা?
-ভালো আছি। আপনি তো বিয়েতে এলেন না। এই যে আমার বর।
বরের কথা বলাতে আমার মনে পড়ল জাঙ্গিয়াটার কথা।
-আমার জাঙ্গিয়াটা তো আর নেয়া হলো না। ওটা আছে তো?
আমার এই নিরীহ গোছের প্রশ্নে নন্দিতার বরের জানি কী হলো! মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। সে শুধু বলল – নন্দিতা একটু এই দিকে আসো তো।
আমি বিদায় বলে চলে গেলাম মানে আবার একটা চক্কর দিয়ে বেড় হলাম। যখন চক্কর কেটে প্রধান সড়কে, দেখি নন্দিতা আর তার বর কথা বলছে। তাদের ঘিরে আছে বেশ কয়েকজন। সেলিব্রেটি মানুষ, স্বাভাবিক ঘটনা। বান্ধবীকে তার বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজে ঘরে ফিরে নাক ডেকে আমি ঘুম। ঘুম ভাঙল রাত তিনটায়। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। সাধারণত আমি এত রাকে ফোন ধরি না। কিন্তু ঝাড়ি দেয়ার জন্য ধরলাম।
-হ্যালো সাব্বির ভাই।
-হ্যা। কে বলছেন?
-আমি রাহাত। নন্দিতার হাসব্যান্ড।
-কী ব্যাপার! এত রাতে ফোন কেন?
-আপনি সত্যি করে বলেন তো ভাই আপনার সাথে নন্দিতার কী সম্পর্ক ছিল? আপনার জাঙ্গিয়া নন্দিতার বাসায় কেন? কী হয়েছিল আমাকে ডিটেইল বলুন। আমি কিছু মনে করব না। আমি অন্যরকম মানুষ।
-ও এই কথা। আরে কয়েক বছর আগে নন্দিতার ফেইসবুক পেইজ থেকে একটা জাঙ্গিয়া কেনার কথা ছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে ঐটা আর নেয়া হয় নাই। আপনাদের বিয়েতে গিয়ে আনতে চেয়েছিলাম। তাও হয় নাই। তাই সেটার কথা বলেছি। তাকে বলেন এইবার অবশ্যই নিব। আমার দরকারও।
-মিয়া ফাজলামি করেন? কোন কথা কখন কোথায় বলতে হয় জানেন না? স্টুপিড লোক। আপনার জন্য নন্দিতা এখন তার বাপের বাড়ি চলে গেছে।
হুট করে সে ফোন রেখে দিল। আমি কিছুই বুঝলাম না। বাড়তি ঝামেলা এড়াতে ফোনটা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।