আজকের দিনটায় বেশ ঝামেলা হবে বোঝা যাচ্ছে। আমি যাব অফিসে কিন্তু মহাখালির এই জ্যামে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এখন অব্দি ৪০ মিনিট শেষ, জানি না আরো কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে। প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে বিবিএ পাশ করার পর রীতিমত ‘ফাইট’ দিয়ে এই বছরেই চাকরিটা জোগার করেছি। এখন পর্যন্ত আমাকে চাকরি থেকে সরানোর ব্যপারে আমার উপরওয়ালা চেষ্টায় আছে। একটু ঊনিশ-বিশ হলে আমি শেষ। আমার স্থলে চলে আসবে তার শ্যালক; এতে তার শশুর বাড়িতে সম্মানোত্তিই ঘটবে; মানুষ মাত্রই পরের বাড়িতে নিজের অবস্থান করতেই ব্যস্ত। এই গোপন সত্য অফিসের সবাই জানে। তবে আমার খারাপ যাচ্ছে না। সময়টা কাজেই লাগছে। কিন্তু এই মহা জ্যাম প্রতিদিন চলতে থাকলে মনে হয় না চাকরিটা চালানো সম্ভব হবে। অবশ্য চাকরিটা যে খুব আনন্দ নিয়ে করছি তাও নয়। যদিও মাস শেষে মোট অংকের টাকা পকেটে আসছে ওবুও করতে হয় কিছু একটা, সে জন্যই এই চাকরি। আমার মধ্যে অস্থিরতা খুব বেশি। কোন কাজ একটানা করতে পারি না আর এটাই সম্ভবত আমার জীবনের গতিটা স্বাভাবিক হতে দিবে না। জ্যাম ছুটে গেছে। প্রিমিয়াম বাস চলছে আর এসির শৈত প্রবাহে চোখে মাদকতা সৃষ্টি হচ্ছে। কী জানি এরা এসির সাথে ঘুমের কিছু মিশিয়ে দেয় কিনা! অবশেষে আমি শৈবাল মাহমুদ সকাল ১০ টার অফিস পৌছলাম ১২ টায়। বনানী থেকে ফার্মগেট আসতে খরচ হলো পুরো সোয়া ২ ঘন্টা।
বিকেলে বাসায় বসে গান শুনছিলাম আর কম্পিউটারে ই-মেইল দেখার পায়তারা করছি। এমন সময় বাসার কলিং বেল ফ্যাস ফ্যাস করে উঠল। গত ২ মাস থেকে কলিংবেলের এই হাল। কাজের ছেলেটাকে বলেছিলাম পাল্টাতে, কিন্তু ওর মনে থাকবে না! আর এখন উঠতেও ইচ্ছে করছে না, কিন্তু উপায় নেই। একটু আগে ছেলেটাকে পাঠিয়েছি পেপসি আনার জন্য। বাধ্য হয়ে উঠতেই হলো। দরজা খুলতেই সামনে বিশাল ফুলের তোড়া। শাহেদ আর দীপু দাড়িয়ে আছে। শাহেদ চিটাগাং গিয়েছিল ঘুরতে ও কবে ঢাকা এসেছে একবার ফোন করে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। ওর মুখ দাড়িতে ভর্তি। সাধুবাবা সাধুবাবা অবস্থা। ওর মধ্যে ভবঘুরে ভাবটা আমার থেকেও পাঁচগুণ বেশি। শুধু পার্থক্য হলো আমি কবিতা লেখি আর ও লেখে না।
-‘শ্যাওলা মিয়া ফুলগুলা ধরো। ১৫০ টাকা দিয়া কিনছি। ফুল কিনতে গিয়া পকেটের সব টাকা শেষ। এখন আমারে ৫০০ টাকা লোন দেও।’ কথাগুলো এক নিশ্বাসে দীপু বলে ফেলল। দীপুর এই এক দোষ: কথা আস্তে বলতে পারে না এবং কথার মধ্যে কোন বাহুল্য নাই। আর এই দুইজন আমার নামের অর্থ শৈবাল থেকে করেছে শ্যাওলা। অবশ্য ইদানিং এদের মুখে হঠাৎ শৈবাল শব্দটা শুনলে নিজেই চমকে উঠি। আমি আসলে শ্যাওলা নামটাকেই বেশি পছন্দ করি। কিন্তু তা প্রকাশ করি না।
-‘ফুলের জন্য ধন্যবাদ দেওয়া লাগবে নাকি? তোদের তো দিয়া দিয়া আমি শেষ হইয়া গেলাম। এখন বাকী আছে খালি থ্যাংকস।’ কথাটা বলে আমি হাসতে লাগলাম। আমি কখনোই এই দুই বন্ধুর জন্য প্রাণ খুলে কিছু খরচ করতে পারিনি। বরং ওরাই আমার জন্য অনেক কিছু করেছে। এমনকি আমি এই যে দুই রুমের বাসাটা নিয়ে আছি তাও দীপুর খালার বদৌলতে। এত কম টাকায় বনানীতে কেউ বাসা ভারা দেবে না। আজকে আমার জন্মদিন। আমি জানতাম কেউ আমাকে উইশ করবে না। কিন্তু এই দুই জনের কথা আলাদা। আমার জন্য এরা ‘বন্ধু অন্ত প্রাণ’।
-‘এখন এতো কথা কওনের কাম নাই। চলো, শার্ট টা গায়ে দেও, আমাদের খাওয়াইবা। পিজা হাটের পিজা আমরা আইজ খামু, ট্যাকা বাইর করো মামু- বলেই হাসতে থাকে সে। নিজের কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ।’ আমি দ্রুত তৈরি হয়ে নেই। বেশি দেরি করলে উল্টা আমাকে এরা খালি গায়েই নীচে নামাতে পারে। দীপুর মাথার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই।
নীচে দীপুর টয়োটা মার্ক-২ দাড় করানো। ওরা দুইজন সামনে আর আমি বরাবরের মতোন পিছনে। দীপু আমার জন্য কখনো গাড়িতে সিগারেট খায়না। আমার এজমার সমস্যার কথা চিন্তা করে দীপু তার এই প্রিয় কাজটা করে না। বেচারা মনে হয় খুব কষ্ট পায়। শুনেছি সিগারেটের নেশা, সব নেশার থেকে ভয়ঙ্কর। দীপু খোশ মেজাজেই গাড়ি চালাচ্ছে। আজকে গাড়ির গতি বেশ কম। স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ডের এটিএম মেশিনের সামনে দীপু গাড়ি থামিয়ে ভিতরে গেল কিছুক্ষন পর ফিরে এলো। গাড়িতে এসেই বলল ‘পিজা হাট কেনসেল। জন্মদিনের দিন এই কবি শালার পেটে পিজা সহ্য হবে না। এরে বাঙালী খাবারের দোকানে নিতে হবে।’ শাহেদ মাথা দুলিয়ে হাসতে লাগল। ও হাসলে মাথা পেন্ডুলামের মতোন দুলতে থাকে। হাসতে হাসতে যোগ করল ‘ওরে টাকি মাছের ভর্তা, শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তার দোকানে নিয়া যা। আর বাবুর্চিরে স্পেশাল ইন্সট্রাকশন দিয়া বেশি করে ঝাল দিতে ক। পরের দিন সকালে শালায় বাথরুম থাইকা আসলে বাংলা সাহিত্যে ঝালের একখান কবিতা যোগ হবেই, আমার কোন সন্দেহ নাই।’ এই কথায় আমরা সবাই হাসতে লাগলাম। আমাদের এই হাসির শব্দে রাস্তার ধারের এক চাচমিয়া বির বির করে উঠল। পিছনে তাকায়ে দেখি কেমন করে যেন চেয়ে আছে। ভাবছে বুঝি ‘বড়লোকের পোলাপানরা সব গেছে!’ দীপু গাড়ি দাড় করালো ‘রসনা বিলাসে’। এদের খাবার এর আগেও আমরা এক সাথে খেয়েছি। রূপচান্দার আইটেম এদের অস্বাধারণ হয়। সন্ধ্যার পর অব্দি আমাদের ভোজন পর্ব চলল। আরো কিছুক্ষন থাকা যেত কিন্তু শাহেদের জন্য থাকা গেল না। শাহেদের টার্ম ফাইনাল সামনে। চিটাগাংয়ে অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। এখন আর সময় নষ্ট করলে নাকি বুয়েট পাশ করতে পারবে না। শাহেদ এবার মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর শেষ বর্ষে। তাকে যেতে হবে আজিমপুর। ‘বালের পরীক্ষায় আমার লাইফ হেল বানায়ে দিবে। শালার কোন দুক্ষে যে বুয়েটে ভর্তি হইছিলাম!’-শাহেদ আক্ষেপ করে। আমরা উঠলাম। বরাবরের মতোন বিল দিল দীপু। আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে গলা বাড়িয়ে দীপু বলল ‘কালকে বাসায় আসিস পারলে, মা তোরে ডাকছে।’ আমি হাত নাড়লাম। বিদায় পর্বটা হলো খুবই সংক্ষিপ্ত।
চারতলা সিড়ি ভেঙে ছাদের মধ্যে আমার দুই রুমের বাসা। সামনে খোলা ছাদ। রাতে হাটাহাটি করা যায়। ঘরে ঢুকে দেখি ছোট্ট রান্নাঘরে কাজের ছেলেটা রান্না চাপিয়েছে। আমি আর তাকালাম নাÑকী রান্না করছে সেটা দেখার জন্য। ঘরে ঢুকে কম্পিউটার অন করে মেইল দেখা শুরু করলাম। আমার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কানেকশন। তাই কম্পিউটার অন করলেই ইন্টারনেট পাওয়া যায়। নতুন কোন মেইল নেই। শুধু ইয়াহু ক্যালেন্ডার সার্ভিস থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠিয়েছে। যদিও পুরো মেইলটাই কম্পিউটার প্রগ্রাম দিয়ে তৈরি, তারপরেও ভালো লাগল। সময় কাটানোর জন্য চ্যাট-আড্ডার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাছাড়া আজকে আমার জন্মদিন, কারো সঙ্গে কথা বললে খারাপ হয় না। আইআরসি১ ডাল নেটে২ সংযুক্ত হলাম। আজ মনটা বেশ ভালো তার উপরে জন্মদিন, তাই প্রতিদিনের কমন নাম ‘শ্যাওলা কবি’ না নিয়ে নিলাম ‘ভবঘুরে মেঘ’। তারপর ঘুকে গেলাম বাংলাদেশ রুমে৩। আজকে রুমে মনে হয় কোন ঝগড়া চলছিল। কারণ রুমের মেইন পর্দায় লেখালেখির কায়দা বন্ধ করে রাখা আছে। আমার প্রতি ব্যক্তিগত বার্তা এলো। রোখসানা নামের কেউ বার্তাটি দিয়েছে। শুধুই ‘হাই’ যার জবাবে আমি লিখলাম ‘হ্যালো’। এরপর আমাকে লিখল ‘নামটা তো বেশ সুন্দর, কবি নাকি?’ জবাবে লিখলাম ‘এই দেশে কাক আর কবির সংখ্যা নিয়ে তো একটা বিতর্ক আছেই। কারো মতে কাকের সংখ্যা বেশি আর কারো মতে কবির। তা সেই ধারায় আমিও কবি। মানে কবিতা লেখার চেষ্টা করি।’ ‘তাহলে একটা কবি শোনান। অনেকদিন কবিতা শোনা হয় না।’ জবাবে লিখলাম ‘ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন/আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপন!/নিরালায় সুর সাধি, বাঁধি মোর মানসীর বেণী,/মানুষ দেখেনি মোরে কোনদিন, আমারে চেনেনি!’ জীবনানন্দ দাশের ‘কবি’ ঝাড়া মুখস্ত লিখে গেলাম। এরপর অনেক্ষন কোন জাবাব নেই ওই প্রান্ত থেকে। অবশেষে সে লিখল ‘খুব ভালো লাগল কবিতাটা। খুবই সুন্দর, কেমন যেন হাহাকার, মাথা তচনচ করে দেয়। কবে লিখছেন এটা? আমি বললাম ‘এটা জীবনানন্দ দাশের কবিতা। আমার না।’ ওপারের মানুষটি বলে ‘আপনার নিজের কোন কবিতা নেই? তবে যাই হোক কবিতাটা আমার ভালো লেগেছে। আমি জীবনানন্দের সব কবিতা পড়ি নাই। তাই বুঝতে পারিনি। আপনার কবিতা শোনান। আমি লিখলাম, ‘ভালোবেসে হেসে হেসে/আমিও যাব মিশে/কোন একদিন,/রবে শুধু ছায়ার মতোন/ভালোবাসা অরূপরতন/আমি প্রতিদিন।’ ‘বাঃ এটা আপনার কবিতা! খুব ভালো। কিন্তু এখানেও কেমন যেন দুঃখ। কবিতায় এতো হাহাকার কেন? আনন্দের কোন কবিতা জানেন না?’ আমি লিখলাম, ‘আমি সবসময় উল্টা কাজ করি তো তাই আনন্দের দিনে আমি দুঃখের কবিতা পড়ি। এতে আমি বেশ ব্যালান্সে থাকি।’ ‘তো কী এমন আনন্দের ঘটনা ঘটেছে আজকে?’ আমি বললাম, ‘আজ আমার জন্মদিন’। ‘ওয়াও। শুভ জন্মদিন।’ এর জবাবে আমি তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। তাকে জানিয়ে দিলাম আমার নাম শ্যাওলা, থাকি বনানী, একটা প্রাইভেট কোম্পানিকে কাজ করি। মার্কেটিং অফিসার। সে জানালো তার নাম রোখাসানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়ে সে। থাকে আজিমপুর। আগে তারা বনানীতেই ছিল। ৭ নম্বর রাস্তায়। আমি শুনলাম। কবিতা নিয়ে মেয়েটির ভালোবাসা আছে তা বুঝতে পারলাম। অবশেষে আমরা ইমেইল ঠিকানা আদান প্রদান করলাম। আজকের মতোন আলাপ শেষ হলো। বিদায় নিলাম চ্যাট রুম থেকে।
আজকে অফিসে গিয়েই সবার প্রথম আমার মেইল চেক করতে বসলাম। মেইল বক্সে রোখসানা ইয়াসমিনের কাছ থেকে একটি মেইল এসেছে। খুললাম। পড়লাম। আবারো পড়লাম। আমার চোখে স্বপ্ন খেলা করছে। কী যে ভালো লাগছে। একই বলে বুঝি নিজেরে হারায়ে আবারো আবিষ্কার। এরই নাম বুঝি স্বপ্নের বাস্তবে পা দেয়া। মেয়েটি আমার কবিতার প্রতি তার স্বপ্নকে জুড়ে দিয়ে বিশাল চিঠি লিখেছে। আরো বলেছে আজকে বিকেল ৫ টায় যেন অবশ্যই চ্যাট রুমে থাকি। আজ আমি অফিস করছি বেশ ঘোরের মধ্যে। কোন কাজ মাথায় আসছে না। আমার এই অবস্থা দেখে মুর্শিদ সাহেব আমাকে বাসায় যেতে বললেন। মুর্শিদ সাহেব আমার উর্ধতন কর্মকর্তা। তার কথা শুনতেই হলো। বাসায় এসেই চ্যাট রুমে ঢুকে বসেই রইলাম। চেয়ার থেকে উঠলাম না। মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিলাম, যাতে কেউ বিরক্ত করতে না পারে। ৫ টা বাজে, তবু সে আসছে না। আমি বসে আসি শকুনের মতোন। শেষ পর্যন্ত সে এলো। দেরির কারণ ভার্সিটি থেকে দেরিতে ফেরা আর ইন্টারনেটের সংযোগ পেতে সমস্যা। আমরা কথা শুরু করলাম। আমার স্বপ্নের কথা বললাম। যে স্বপ্নগুলোকে শাহেদ এবং দীপু পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মানতে রাজি নয়, সেগুলো সব বললাম। মেয়েটি আমার স্বপ্নের সাথে তার স্বপ্নের নৌকা ভাসালো। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথে আমাদের স্বপ্ন ভেসে বেড়াতে থাকল।
প্রতিদিন অফিসের ফোনে সে ফোন করে, আমরা কথা বলি। কোন দিনো মোবাইল ফোনে সে ফোন করে না। এমনকি মোবাইল নাম্বার পর্যন্ত নিতে তার আগ্রহ নেই। খারাপ যাচ্ছে না। প্রতিদিন অফিসে যাই। বিকেলে বাসায় এসে নাস্তা খেয়ে রোখসানার সাথে চ্যাট করি। আমার কবিতার খাতা থেকে ওকে কবিতা শোনাই। জীবনানন্দের বই থেকে কবিতা পড়ি। ও শোনে। বাড়াবাড়ি রকমের উচ্ছাস প্রকাশ করে। ফলতঃ আমার স্বপ্নের গাঁথুনি পাকাপোক্ত হতে থাকে। যার মনে কবিতা লেখার ঝোক তার তো এমন মানুষ পছন্দ হবেই। এই রুটিনে এক মাস চলে গেল। এই সময়ে শাহেদ এবং দীপুর সাথে দেখা হয়নি। শুধু ফোনেই যোগাযোগটা অক্ষুণœ আছে।
একমাস পরের কথা। রোখসানার কাছে আমি ওর ছবি চাইলাম। ও বলে ‘ছবি তো দিতে পারব না। ভাইয়ার নিষেধ আছে। তাছাড়া আমার ছবি স্ক্যান করা নেই। আমি আপনাকে ছবি দিতে পারব, কিছুদিন পর।’ ‘তোমার ভাইয়া তো পীর বাবা হয়ে গেছে। এতো পণ্ডিতি করে কেনো?’- আমি লিখলাম। সে লিখল ‘পণ্ডিতি তো করবেই। ভাইয়া খুব ভালো ছাত্র। এবার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে। বুয়েটে আছে।’ আমি আর কী বলি! অভিমান করে চ্যাট রুম থেকে বেড় হয়ে যাই। পরের দিন শুক্রবার। অফিস বন্ধ। মনের মধ্যে অভিমানের বোঝা। তাই বেড় হলাম শাহেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে, ওর মা সংবাদ দিয়েছে। শুক্রবার তাই রাস্তাঘাট ফাকা। আজিমপুর যেতে বেশি সময় লাগল না। শাহেদদের ফ্লাট ৩ তলায়। বেল দিলাম। দরজা খুলে দিল শান্তা, শাহেদের বোন। ‘কেমন আছো শান্তা? সব খবর ভালো?’ শান্তা সভাব সুলভ মিষ্টি করে হাসল, কিছু বলল না। ‘শাহেদ কোথায়? ওকে ডাক দাও আর আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়াও।’ শান্তা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল ‘আচ্ছা’। আমার শরীর রিন রিন করে উঠে। রোখসানার সাথে মিল আছে গলার। হয়তো মনের ভুল। রোখসানার কথা সব সময় ভাবি তাই হয়তো সবার গলা তার মতোন মনে হয়। শাহেদ এলো, সঙ্গে তার মা। আমি দাড়িয়ে সালাম দিলাম। শাহেদের মা আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম। শান্তা পানির গ্লাস নিয়ে সামনে দাড়ালো পানির গ্লাস নিতে গিয়ে তার চোখের দিকে তাকালাম। অপূর্ব সুন্দর সে চোখ। ডাগর ডাগর চোখে রাজ্যের সরলতা। চোখের মধ্যে যেন নিসর্গ আঁকা আছে শিল্পীর তুলি দিয়ে। আমি পানি শেষ করলে শান্তা চলে গেল। শান্তা কোন দিনও কথা বলে না। লক্ষী সভাবের মেয়ে। এমন ভালো মেয়েকে যে ঘরে পাবে তার ভাগ্যের কথা চিন্তা করে হিংসা লাগে রিতিমতন। শাহেদের মা জানালেন আসল খবর। শান্তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। চিটাগাংয়ে বাড়ি। আমি খুবই খুশি হয়ে উঠি। যোগ্য পাত্রই পাওয়া গেছে। আমাকে দিয়ে বিয়ের কার্ডের দাওয়াতপত্রের লে-আউট করানোর ইচ্ছে। আমি আরো খুশি হয়ে উঠি। শান্তার মতোন লক্ষী মেয়ে তার উপর শাহেদের বোন। এর বিয়ের কার্ডের দায়িত্ব নিতে আমার আনন্দ হওয়ারি কথা। বর পক্ষ, কনে পক্ষের সমস্ত কিছু কাগজে লিকে দিতে বললাম। শাহেদ তা আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিল। বাসায় ফিরলাম তাড়াতাড়ি।
আমার পৃথিবী অন্ধকার। বাড়িঘর সব দুলছে। শুধু মনে হচ্ছে আমি চেয়ার থেকে গড়িয়ে পরে যাচ্ছি। চেয়ারে ঘুমিয়ে পরে ঘুম ভাঙার সময় যেরকম অনুভূতি হয় অনেকটা সেরকম অনুভূতি হচ্ছে। আমি দেখছি কনের পরিচিতি। কনের নাম রোখসানা ইয়াসমিন (শান্তা)। ফলিত রসায়ন, প্রথম বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমার ক্ষণ-ধৈর্য-স্বভাব এবং উদাসিন্য কোন দিন কোন কিছু জানার আগ্রহ তৈরি করে নি শাহেদদের বাসার মানুষদের সম্পর্কে। আমি শুধু শাহেদ আর দীপুরই খবরই রাখতাম। সে রাতেই আমি খুলনা রওনা হলাম, আমার বাড়ি। যাওয়ার আগে দীপুকে ফোন করে বললাম, ‘শাহেদকে বলিস গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাড়িতে যাচিছ। তাই বিয়ের কার্ডের কাজটা করতে পারলাম না।’
১১ দিন খুলনায় কাটানোর পর আজ সকালে ঢাকায় ফিরেছি। আজকে শান্তার বিয়ের অনুষ্ঠান। গতকাল চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে আমাকে, জেনেছি মোবাইলে। আমি চুপ চাপ বন্ধ কম্পিউটার স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে আছি। দুুুুপুরের একটু আগে দীপু এলো। ‘ওই শালা কবির বাচ্চা। আইজ শান্তার বিয়ার অনুষ্ঠান আর তুমি শালা থাকো খুলনা। আমি আর শাহেদ দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া ফুল প্যান্টরে হাফপ্যান্ট বানায়া ফালাইলাম আর তুমি এখনো বইসা আছো?’ আমি ম্লান হাসলাম। আমার চোখের নীচে কালি। দীপুর এসব নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। ‘দীপু আমারে একটা র্যাপিং পেপার আইনা দেতো।’ দীপু পেপার আনতে গেল বিনা বাক্য ব্যায়ে। দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ আমার হাতে, যেটি থেকে শান্তাকে রাত জেগে জেগে কবিতা শোনাতাম, তার প্রথম পাতায় লিখলাম, ‘আমিও যাব মিশে/কোন একদিন।/তোমার হাতের পরে অন্য একটি হাত।’ দীপু ফিরে এসেছে। আমাকে সাহায্য করছে বইটা সুন্দর করে প্যাক করতে। দুপুরে দু’জনে বেড় হলাম ধানমন্ডির পার্টিপ্যালেস কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে। সেখানে আজ অনেক বেশি হৈচৈ। বইয়ের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে কনের স্টেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি স্থির চোখে। খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে শান্তাকে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। প্যাকেটটি হাতে তুলে দিলাম হাতে; আমার হদয়তান্ত্রিক নিউরাল নেটওয়ার্ক ডিসকানেক্ট হলো। আর দাড়াই না। হাটা শুরু করি। বুকের ভেতর নিরো তার বাঁশি বাজানো শরু করেছে; কিছু একটা ধবংস তো হবেই। ফাইবার অপটিকে ভেসে বেড়ানো আমার ব্যকুলতা ইন্টারনেট বুঝুক বসে বসে, কোন দায় নেই আমার।
পরিশিষ্ট্য
১। আইআরসি (IRC-Internet Relay Chat)-ইন্টারনেটে কোন একটা সার্ভার নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে আড্ডা দেয়ার বিশেষ সার্ভিস।
২। ডাল নেট (DAL NET-www.dal.net)-ইন্টারনেটে আড্ডা দেয়ার সবচেয়ে বড় সার্ভার নেটওয়ার্ক।
৩। চ্যাট রুম-আড্ডা দেয়ার সার্ভার নেটওয়ার্কে নির্দিষ্ট কোন স্থান। যেখানে রুমের বৈশিষ্ট অনুযায়ি লোকজন প্রবেশ করে আড্ড দেয়। সাধারণত এই রুমগুলোর নাম দেশের নামে হয়ে থাকে যাতে সেই দেশের লোকজন একখানে প্রবেশ করে আলাপ জমাতে পারে।
1 comment
Jotil hoise golpo ta. Chalai jao.
Tobe golper sahte naam ta thik miltese na … chinta kore dekho