মানুষের জন্মের প্রক্রিয়াটি বেশ মজার। পুরো অনিশ্চিয়তায় ভরা একটা সিনেমার নাম মানুষের জন্ম। একটা মাত্র শুক্রাণু সুযোগ পায় গর্ভধারণের প্রক্রিয়াতে। অথচ কয়েক লক্ষ্য শুক্রাণু অংশগ্রহণ করে সেই যাত্রায়। এই কয়েক লক্ষ্য শুক্রাণুর কয়েক লক্ষ্য সম্ভাবনা। একটির জায়গায় আর একটি হয়ে গেলে জন্ম নেয়া মানুষটির স্বভাব এবং চালচলনের পার্থক্য হয়ে যেত। এই অদ্ভুত অনিশ্চিয়তার খেলা শেষে মানব সন্তানেরা জন্ম নেয়। আমিও নিয়েছিলাম। আমার জন্ম সেই ১৯৮০ সালের ২১জুন, সকাল ১১:৫৫ মিনিটে, বাংলায় আষাঢ়ের ৭। বৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল কুড়িগ্রামের রাঙালীরবস গ্রামে। আমাদের বাড়ি ভারতের আসাম রাজ্যেই পাশেই। অথচ সেদিন ছিল গগন ফাঁটা রোদ। পিচঢালা পথ হলে নির্ঘাৎ জুতোর মধ্যে তা উঠে আসত। পিচের পথ সেই সময় ছিল না। কাদামাখা মেঠোপথ ধরে আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা জড়ো হয়েছিলেন আমার জন্মের স্বাক্ষী হতে।
![](https://nirjhar.com/wp-content/uploads/2019/11/45507649_2259122870970316_5074180496431251456_n.jpg)
আমার জন্ম হলো একরকম মৃত অবস্থায়। আমার শ্বাসপ্রশ্বাস ছিল না কয়েক মিনিট ধরে। ড: মজিবর রহমান, এম.বি.বি.এস তখন রায়গঞ্জ হাসপাতালের ডাক্তার। ডাক্তারের প্রজ্ঞায় আমার আবার নিশ্বাস ফিরে আসে। আসলে এই ঘটনা আমার আত্মীয় স্বজনেরা যখন বলেন, তখন অনেক মজার হয়। জানতে পারি সেদিন ফুলকুমার নদী পার হতে গিয়ে কারা কারা পানিতে পরে গিয়েছিলেন। জানা যায় আমার দুই দাদী কেমন মাতম করে কাঁদছিলেন। আমার একমাত্র চাচা কেমন করে বাড়ির চারপাশে কাঁদতে কাঁদতে চক্রাকারে ঘুরছিলেন। এইসব গল্প আমার শৈশবে শোনা। ছোটবেলা থেকেই নিজেকে খুব স্পেশাল ভাবতে শিখেছি এই ঘটনা থেকেই।
আমার জন্মের কথা আয়োজন করে লিখলাম এতদিন পরে। জন্মের পর আমাকে দেখে আমার ডাক নাম রাখলেন আমার দাদী। সেই নাম হলো ননী। আমি ননীর মতোন ফর্সা ছিলাম। এমনকি সবাই ভাবত আমি কোন মানুষের বাচ্চাই না! এখনো আমার কিছু আত্মীয়-স্বজন আমাকে ননী নামে ডাকে। এমনকি স্কুলের বন্ধুরাও। কিন্তু এই নামটি একটা কারণে ঢাকা পরে গেল। আকিকাতে নাম রাখা হলো মো: লুৎফর রহমান। ডা: লুৎফর রহমানের সাথে মিল রেখে এই নাম রাখলেন আমার দাদাজান, খলিলুর রহমান ব্যাপারী। ব্যপারী আমাদের পারিবারিক নাম। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় সেন্টার পরীক্ষা নামের একটা পরীক্ষা ছিল ১৯৯০ সালে। সেই সার্টিফিকেটে আমার নাম মো: লুৎফর রহমান ব্যাপারী। এই নাম থেকে লুৎফর রহমান নির্ঝর হওয়ার গল্পটাও বেশ মজার। এই গল্পটা অনেক নারীবাদি একটা গল্প।
অজপারাগাঁ শব্দটা আমাদের গ্রামের জন্য প্রযোজ্য। প্রত্যন্ত অঞ্চল। কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার রায়গঞ্জ ইউনিয়নের রাঙালীরবস গ্রামে। ছোটবেলায় যাতায়াতের জন্য ছিল মহিশের গাড়ি। মোটর সাইকেল ছিল বাবার। গ্রামের কাদামাখা রাস্তায় মোটারসাইকেল চালাতে হলে হতে হবে অনেক দক্ষ। মোটরসাইকেল পিছলে পরা ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। সেই গ্রামে বিয়ে করে আমার মা এলেন।
পূর্বপুরুষদের জমিদারি ব্যবসা নেই। কিন্তু জমিদারি প্রথা লোপ পাওয়ার পরেও অনেক জমি। এই জমিতে কী করতে হবে, সেই ধারণা অস্পষ্ট। তখনো ইরি ধানের প্রচলন হয় নি। সেই অস্থির সময়ে বাবা পারিবারের হাল ধরলেন এবং বিয়ে করলেন ১৯৭৯ সালের ২১শে জুলাই। মা তখন সরকারি চাকরি করেন। পরিবার পরিকল্পণা অধিদপ্তরের মাঠ সমন্বয় কর্মী। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে পুরুষতন্ত্র সেই সময়ে কতটা কঠিন ছিল।
একটা শিশুর জন্ম হলো। একটা মায়ের প্রথম সন্তান। অথচ সেই মায়ের সন্তানের কোন কিছুতে কিছু বলার অধিকার থাকল না। মুসলিম পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে নামকরণ থেকে সবকিছু অধিকার করলেন দাদাজান এবং দাদী। আমার নাম নিয়ে মায়ের ইচ্ছের কথাটা আমাকে শুনতে হলো আমার বয়স যখন ১৯ তখন। সালটা ১৯৯৯।
একদিন মা অনেক দুঃখ করে জানালেন এই পরিবারে তার কোন ইচ্ছেই কোনদিন পূরণ হয় নি। এমনকি নিজের বাচ্চার নামটা পর্যন্ত তিনি রাখতে পারেন নি। তখন তিনি জানালেন তার ছেলের নাম তিনি রাখতে চেয়েছিলেন নির্ঝর। শুধু ডাকনামটুকু। কথাগুলো বলতে গিয়ে মা কেঁদে ফেললেন। আর আমি! আমি তখন পুরোদস্তুর কবি। মানে কবিতা লিখি, কাধে শান্তিনিকেতন মার্কা ব্যাগ, পাঞ্জাবী। বেশ কায়দা করে চলি। অন্যরকম ব্যাপার। সেদিন মাকে বলেছিলাম তার দেয়া নামটাই আমি প্রতিষ্ঠিত করব। সত্যিকার অর্থে সেটাই ছিল আমার প্রথম নারীবাদি চর্চা।
আমার মা সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ বই পড়তে পছন্দ করেন তা শুনলে এবং দেখলে অনেকেই চোখ কপালে তুলে ফেলবেন। মায়ের পড়াশুনা করার এই অভ্যাস আমরা সবাই পেয়েছি। এমনকি আমার তিন বোন এবং মায়ের সাথে যখন আড্ডা দেই, বাইরের কেউ সেই আড্ডা বুঝতে পারবেন না। অনেকটা কোডেড ভাষা। বিভিন্ন বইয়ের ক্যারেক্টারের ভাষায় আমরা কথা বলি।
আজ ৫ ই নভেম্বর। আমার একমাত্র কন্যার জন্মদিন। আমার কন্যা অরুন্ধতী রূপকথার আজ ৯ বছর পূর্ণ হলো। আমার মেয়েকে নিয়ে অনেক গল্প করার কিছু নেই। কন্যা আমার সাথে থাকে না। তার মায়ের সাথে মালয়েশিয়ায় থাকে। আমি তাকে দেখেছিলাম তার ১০ মাস বয়সে। তার বন্ধুরা গোপনে ফেইসবুক থেকে ছবি চুরি করে পাঠায়। আমি তার ছবি, তার আঁকা-আঁকি নিয়ে থাকি। স্বার্থক মানব জনম!